সহযাত্রী
*******
✍ শ্যামাপ্রসাদ সরকার
পুরোনো নিউমার্কেটের এক্কেবারে পিছনদিকটায় যেখানে বড়দিনের আগে ইয়াব্বড় বড় বড় টার্কি আর অতিকায় দেশীমোরগের স্তুপীকৃত খসানো পালক গুলো স্তুপ হয়ে একটা আসন্ন মহাভোজের ইঙ্গিত দেয়,তার পাশ দিয়ে একটা ব্লাইন্ড লেন চলে গেছে স্যাঁতস্যাঁতে সরীসৃপের মত। গলিটা শেষ হয়েছে একটা ছোট্ট দুকামরার জীর্ণ বাড়ির সিঁড়িতে এসে। দরজায় এখনো প্রায় উঠে যাওয়া নেমপ্লেটটা দেখলে হিগিনস্ নামটুকু কায়ক্লেশে পড়া যাবে হয়তো।
ঔপনিবেশিক কলকাতার এই শতচ্ছিন্ন জীর্ণ অবশেষটুকুতেও কত আশ্চর্য গল্প লুকিয়ে থাকে তার ঠিক নেই। আজকের মখমলের মত ঝাঁ চকচকে কলকাতার পাঁচতারা কনফেকশনারীর গুলোর পাশাপাশি এখানকার শিরা ওঠা হাতের রিচ প্লাম বা ফ্রুট কেকের সঙ্গে ডোনাটস, আর হ্যান্ডমেড জিঞ্জার ওয়াইনের তলানিটুকুর নির্যাসও আসলে একটা শিকড়হারানো বর্ণসংকর মানুষের দুঃখসুখের জয়পরাজয় গাথাই ফুকরে ফেরে।
******
একসময় এপাড়ায় শৌখিন লোকের আনাগোনা কম ছিল না। সে সময় ফ্লুরিজ, গ্রেট ইস্টার্ন,ফারপো ছিল উচ্চবিত্তের। নাহুম ছাড়া মধ্যবিত্তের নাগালে আর যে নামকরা কেকের দোকানটি ছিল এই সেদিন অবধি সেটা হল হিগিনস্ সাহেবের কেক। অবশ্য নামেই সাহেব, আসলে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। হিগিনস্ রা আর্মানী। হিগিনসে্র ঠাকুর্দা সেই উনিশ শতকের শেষদিকে এদেশে আসে। তারপর থেকে ওরা এই শহরেরই লোক। হিগিনসের বাবা এই কেকের দোকানটা দেন। মুনলাইট বেকারীর একটা রঙিন ইতিহাস ছিল বৈকি। প্লামকেক, ফ্রুটকেক, ক্রঁশো, মাফিন, ক্রীমরোল এসবই একসময় মধ্যবিত্ত বাঙালির একদিনের সাহেবী রসনা ও পকেট এই দুইএরই মান রক্ষা করেছে।
দোকানটা উঠে গেছে আজ প্রায় পাঁচবছর হল। ওখানটায় এখন একটা ঝাঁ চকচকে চুল কাটার সালোঁ। ভালো কারিগর, খরচাপাতি, মুনাফা সবই কালের স্রোতে যেতে যেতে শেষে একদিন দোকানটাকেও নিয়ে নিল। এককালীন টাকা অবশ্য কম পাননি বুড়ো হিগিনস্ তবু কতকালের অভ্যেস, ক্যাশবাক্স, কলোনিয়াল কড়িকাঠ আর বেকারীর ওভেনের গন্ধটার বিনিময়ে তা অবশ্য কিছুই না।
*******
এই তো গতবছর অবধি বুড়ো বুড়ি মিলে প্লাম কেক আর জিঞ্জার ওয়াইন বানিয়েছিল বড়দিনে। এবছর থেকে তাও এবার বন্ধ। সাতমাস হল জেনি এখন প্যারালাইস্ড। কথা বন্ধ, স্মৃতিশক্তিও যাওয়ার পথে। শুধু ছলছলে নীল চোখের দৃষ্টিতে তার শুধু দিন গোণার অপেক্ষা।আর কদিন বাদেই বড়দিন। তিয়াত্তর বছরেই কি এই উৎসবের যৌথযাপন এবার থেমে যাবে চিরদিনের মত?
বুড়ো হিগিনস্ চার্চে এখনো যায় ফি রোববার। ফাদারটি ছোকরাবয়সী। জ্যাক আজ বেঁচে থাকলে এই রকম বয়সেরই হত। কার্গোশিপের চাকরী নিয়ে বারোক্লাসের পড়া শেষ হতে না হতেই বিদেশ পালাল। কয়েকবার রঙীন পোস্টকার্ড পাঠিয়েছিল সে বটে ন্যুইয়র্ক আর মার্সেই থেকে, সেই প্রথম আর সেই শেষ। তার অনেককাল পড়ে একটা টেলিগ্রাম আসে তার মৃত্যুসংবাদ নিয়ে। সাধারণ হার্টফেলের ঘটনা কিন্তু বাপ মা র কাছে তাই ছিল হৃদয়বিদারী।
*******
কাল আবার বড়দিন। গোশালায় জাবপাত্রে যে শিশুটি ভূমিষ্ট হল নিতান্তই অবহেলায়, লোকচক্ষুর আড়ালে, তার মাথাতেই একদিন উঠল রাজাধিরাজের কাঁটার মুকুট,প্রেমের যথার্থ মূল্যে। বয়স হচ্ছে সব কিছুতেই বেশী বকবক করে ফেলার বদঅভ্যাস এখন। মহল্লার ছোকরারা তাই নিয়ে ঠাট্টা করে,আর বুড়োরা এড়িয়ে যায়। তার আছে একজনই নীরব শ্রোতা সে হল জেনী।
বিছানায় মিশে যাচ্ছে সে দিন প্রতিদিন।।হিগিনস্ একাই সব কাজ করে দেয় তার। স্পঞ্জ করিয়ে দেওয়া, সময়মত বেডপ্যান দেওয়া, পাউভার মাখানো সব। জেনী একসময় তার ব্লন্ডরঙা একমাথা চুল আর ঝকঝকে স্মার্ট নীল চোখে তারও মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছিল। কম্পিটিশনও কম ছিল না। কিড্ স্ট্রীটের রনি স্যান্টোসার সাথে সোডার বোতল নিয়ে মারপিটও হয়েছে কতবার। ভাঙা বোতলের টুকরোয় কাটা দাগটা হিগিনস্ এর চিবুকে আজও রয়ে গেছে। জেনী বলত ‘লাভ স্পট’।
********
আজ সেই জেনী শূন্য দৃষ্টিতে হিগিনস্ এর অনর্গল বকবকানি শুনে যায়। সেও জানে এর কোনওটাই জেনীর মাথায় আর কোনওদিন ঢুকবে না, তবুও পাশে বসে এই একতরফা গল্পটা রোজ দুবেলা না করলেই নয়। ইসমাইল বলছিল কথায় কথায় একদিন ‘আপনি যে এত বকবক করেন উনি তো আপনাকে চিনতেই পারেন না আর! ‘ মাথা গরম হয়ে গেছিল হিগিনসে্র। চোয়াল শক্ত করে উত্তর দিয়েছিল সেদিন ‘ও ভুলে গেছে বলেই তো বেশী করে আমায় মনে রাখতে হয় যে ও আসলে আমার কে ! ও তুমি বুঝবে না !’ ইসমাইল আর কথা বাড়ায় নি তারপর।
একবাটি গরম স্যুপ আর রুটি নিয়ে জেনীর পাশে এসে বসে হিগিনস্। যতসব পুরোনো কালের গালগল্প ফাঁদতে বসে তার সাথে। ঘোলাটে পঞ্চাশ ওয়াটের বাল্বের আলোর নীচে এক ট্র্যাজেডি নাটকের অলৌকিক মনোলগ যেন।
মহল্লায় টুনিলাইটের চেন আর রঙীন বাতি দেওয়া তারা গুলো টাঙাচ্ছে ছোকরা ছেলেপুলের দল। গোমসে্র রান্নাঘর থেকে কেক বানানোর অতিপরিচিত গন্ধটা ভেসে আছে। গোমস্ রা আলিগড়ি মাখনটা বেশী দিয়েছে এবারে মনে হচ্ছে, কেকটা শক্ত না হয়ে যায় ! বড় গ্র্যান্ডফাদার ক্লকটায় বারোটা বাজল বলে। ক্যারল গাইয়ে ছোকরাগুলো ব্যাঞ্জো আর গীটার নিয়ে তো এখনো বেরোলো না !
*******
দূর থেকে চার্চের মিডনাইট মাসে্র গানের কলি আর অরগ্যানের আওয়াজটা এবার কানে আসছে। কাঁপা কাঁপা হাতে বাইবেল আর রোজরীমালাটা নিয়ে জেনীর জীর্ণ আঙুলগুলো মুঠির মধ্যে ধরতেই একটা ঠান্ডা নিস্পন্দ কঠিন স্পর্শ অনুভূত হল।ওর কোটরাগত চোখদুটো আধবোজা আর মুখটা ঈষৎ খোলা। জেনী একসময় খুব কথা বলত তখন হিগিনস্ এর চুপ থাকার দিন ছিল ! সেইসব পুরোনো দিনে ফিরে যাবার আমন্ত্রণই কি যাবার বেলায় দিয়ে গেল সে। সারা বাড়ীময় একে একে মোমবাতি গুলো সব জ্বালিয়ে দেয় হিগিনস্। পরম করুণাময় তার কন্যাটির ভবযন্ত্রণার সমাপ্তি ঘোষণা করলেন অবশেষে। ” উইশ্ ইউ আ মেরী ক্রিসমাস উইথ আ লটস্ অব লাভ এন্ড কিসেস্ মাই ডার্লিং জেনী !” অট্টহাসির সাথে হাততালি দিয়ে ওঠে বুড়ো হিগিনস্।
********
কিন্তু একটাই সমস্যা রয়ে গেল ! বিয়ের পর থেকে গত পঞ্চাশটি বছরে একটি মুহূর্তের জন্য জেনীকে একা কোথাও ছাড়তে পারেনি হিগিনস্। এমনকি দুপায়ের দূরত্বের রডন স্ট্রীটের ওর ভাই এর বাড়িতে গেলেও সহযাত্রী ওকে হতেই হত। আজ বেচারীর এতদূরের শেষযাত্রাতে এবার তো তাহলে একাই যেতে হবে ওকে? ও পারবে কি?
–~০০০XX০০০~–