“কে দোষী ?”
✍ সোমনাথ প্রামানিক
“জীবনের অন্তিম পর্যায়ে এসে আমাকে যে এমন একটা হৃদয় বিদারক ঘটনার বিচার করতে হবে তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি ” বার বার এই কথাটি রাত্রে শুয়ে চিন্তা করতে থাকেন সত্তর বছরের ভদ্রলোক চিন্তাহরন বাগচী। কারণ তিনি যে একজন বিচারক, একজন নিরোপরাধ মানুষ ও যেন তার ভুল বিচারের কারণে শাস্তি না পান।
বাঁকুড়া জেলার কেনেটি থানার অন্তর্গত শান্তাশ্রাম গ্রাম, প্রত্যন্ত গ্রাম যেখানে বিচার ব্যবস্থা প্রাথমিক অবস্থায় পাড়ার মোড়ল বা গ্রাম প্রধানের উপর যথেষ্ট ভাবে নির্ভর। সুদক্ষ বিচারক হলে অনেক ক্ষেত্রে থানা বা কোর্টে যাওয়ার আগেই সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। ঠিক সেই রকমই ঐ গ্রামের চিন্তাহরন বাবুর শিক্ষাগত যোগ্যতা খুব বেশি না থাকলেও তিনি ছিলেন একজন চিন্তাশীল সুদক্ষ বিচারক।আর্থিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা থাকা সত্যেও তিনি যথেষ্ট সংযত ও উদার মনস্ক, কিন্তু তিনি যখন বিচারকের আসনে তখন ঠিক তত টাই কাঠিন্য তার সাথেই শাস্তির বিধান দেন।জীবনে অনেক বিচার তিনি করেছেন কিন্তু আজ যে বিচার তিনি করবেন তার হিসাব যে তিনি কিছুতেই করে উঠতে পারছেন না। আগামী কাল বিকালে বিচার সভা বসার আগেই তাকে হিসাবটা মিলিয়ে নিতে হবে তাই কিছুতেই রাত্রে ঘুম আসছে না। মধ্যরাত্রে স্ত্রী নিরুপমা দেবী জেগে গিয়ে বললেন “কিগো তুমি এখনো ঐ সবুজ-সাথীর কথাই ভাবছো, তোমাকে নিয়ে আর পারা যায় না বাপু, রাত জেগে শেষে শরীর টা খারাপ হোক”। তিনি তার স্ত্রী কে বললেন “তুমি এর আর কি বুঝবে, এই গ্রামের মানুষ আজ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে, আমি কি বলি তার উপরে দুটো জীবন আর একটা সংসার ভাঙা গড়ার প্রশ্ন জড়িয়ে আছে”।নিরুপমা দেবী বললেন “তা কাল তো তোমার ছেলে বাড়ি আসছে তখন না হয় বাপ ছেলে মিলে এক সাথেই বিচার করতে বোসো, অনেক হয়ে ছে এবার ঘুমও দেখিনি”। আরে আমি তো ভুলেই গেছিলাম কাল তো চঞ্চল বাড়ি আসছে,সকালে এই বিষয় টা নিয়ে ওর সাথেই একটা শলাপরামর্শ করবো, তা না হলে এত কষ্ট করে ছেলে কে আইন নিয়ে পড়াচ্ছি কেন! এই বলে তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন।
প্রত্যুষে কৃষ্ণ নাম নিয়ে তিনি প্রতিদিনের মতন মাঠে চলে যান, মাঠের কাজ দেখাশোনা করে সকাল আটটার সময় বাড়ি ফিরে আসেন, আজও তার ব্যতিক্রম হোলোনা। বাড়ি ফিরে স্ত্রী কে জিজ্ঞাসা করলেন ”কিগো চঞ্চল কি এসেছে”?নিরুপমা দেবী একটু রেগে গিয়েই বললেন “হ্যাঁ বাথরুমে গিয়েছে , তোমার তো দেখছি তর সইছে না, আগে একটু কিছু খেতে টেতে দাউ তার পর না হয় তোমার ঐ বিচার নিয়ে বোসো”। এরইমধ্যে চঞ্চল এসে উপস্থিত , বাবার পায়ে একটা প্রনাম করে বলল – “বাবা তোমার শরীর টা এখন ভালো তো, প্রেসরটা চেক করিয়ে ছিলে, ডাক্তারবাবু কিন্তু তোমায় টেনশন করতে বারন করে ছিলেন”। নিরুপমা দেবী দুই থালা খাবার নিয়ে উপস্থিত, ওখানকার সকালের খাবার বলতে থালাভরতি মুড়ি আর গুড় একটা ছাঁচি পিঁয়াজ। “হ্যাঁ হ্যাঁ আমার শরীর ভালো আছে তা তোর পরীক্ষা কেমন হলো? এই বলে চিন্তাহরন একটা মুড়ি ভর্তি থালা নিজের কাছে টেনে নেন। “পরীক্ষা তো ভালোই হয়েছে, উকিল কাকুর সাথেও নিয়মিত কোর্টের কেসগুলো নিয়ে স্টাডি করছি, মুড়ি গুড় খেতে খেতে চঞ্চল বলল – “হ্যাঁ আমায় তো বেনু (উকিল, দূর সম্পর্কের ভাই) মাঝে মাঝে ফোন করে – অনেক কথাই হয়, ও বলে চিন্তাদা তোমার ছেলে দেখবে একদিন ওকালতি পেশায় খুব নাম করবে, আমিও সেই আশাই করি ! যাকগে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে ওপরের ঘরে আই তোর সাথে একটা জরুরি বিষয় নিয়ে আলোচনা আছে বলে চিন্তাহরন বাবু দোতলায় ঘরে চলে যান”।
প্রাতঃরাশ শেষ করে চঞ্চলও আগ্রহে বাবার কাছে গিয়ে বলে – “হ্যাঁ বাবা বল”। চিন্তাহরণ বাবু বলেন “আমাদের গ্রামে একটা পারিবারিক সমস্যার জন্য বিচার সভা বসেছে, সেখানে আমাকে সবাই একটা সুষ্ঠু বিচার করতে বলেছে, কিন্তু আমি কিছুতেই সমাধান করতে পারছি না কারণ অপরাধী যাকে দেখানো হচ্ছে সে একজন মা, আর তার অপরাধ সে কিনা তার সন্তানের মৃত্যুর কারণ”। “তা একটু ডিটেল্সে যদি বলো আমার বুঝতে সুবিধা হয়।” এই বলে চঞ্চল পা তুলে খাটের উপর বাবু হয়ে বসে। চিন্তাহরণ বলেন, ”আমাদের ঐ পূবপাড়ার সিধু মন্ডলের ছেলে সবুজ কে তুই তো চিনিস , আরে তোর সাথে প্রাইমারি স্কুলে পড়ত”। চঞ্চল বলে ”হ্যাঁ হ্যাঁ ও তো প্রাইমারি পর্যন্ত পড়ে আর পড়লো না, চাষের কাজটা ভালোই করতো শুনেছি,ওর পরিবারে সমস্যা !” “হ্যাঁ তারপর শোন – সবুজের বিয়ে হয়ে ছিল বছর দুয়েক আগে ঐ বালসির উত্তরা গ্রামের একটি মেয়ে সাথীর সাথে। মেয়েটি খুবই অভাবী ঘরের হলেও শান্তশিষ্ট স্বভাবের ভালো মেয়ে, বিয়ের বছর খানিকের মাথায় ওদের একটি ছেলেও হয়, বেশ সুখেই সংসার করছিল। বাচ্চাটিও এক বছরের ফুটফুটে হেঁটে ঘুর ঘুর করে খেলে বেড়াতো, সিধুও সপ্তান্তে সভা সমিতিতে আসলে কোলে করে নিয়ে আসতো, আমিও দেখেছি বেশ মিষ্টি বাচ্চাটা।” এই বলে চিন্তাহরণ একটা দীর্ঘ নিঃস্বাস ছেড়ে চুপ করে যায়। চঞ্চল এতক্ষণ অতি মনোযোগ দিয়েই সব কথা গুলো শুনছিলো। কিন্তু বাবাকে হঠাৎ চুপ করে যাওয়া দেখে অবাক হয়ে বলে, ”বাবা বলো তারপর কি হলো”? চিন্তাহরণ বাবু মৌনতা ভঙ্গ করে বলেন, “অদৃষ্টের লিখন যে এই ছিল তা তো কেউ স্বপ্নেও কল্পনা করেনি। বাচ্চাটি দিন কুড়ি আগে ছাদের সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়ে মারা যায়। আর সবুজ এবং ওদের পরিবারের বক্তব্য সবুজের স্ত্রী সাথীর জন্যই নাকি বাচ্চাটি মারা গেছে। তাই সবুজ ওর পরিবার ঐ বৌ-কে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। বলছে সবুজ নাকি আর ঐ বউ নিয়ে সংসার করবে না কোর্টে গিয়ে ডিভোর্স দেবে। বউটির বাপের বাড়ির লোকজন আমাদের গ্রামের সভা সমিতিতে এসে বিচার চেয়েছে। তা আজ তিন দিন ধরে বিচার চলছে, সবাই ধরেছে আজ আমাকেই ফাইনাল বিচারটা করে দিতে হবে।” এই বলে চিন্তাহরণ ছেলের প্রতিউত্তরের প্রতীক্ষা করতে থাকে। “সবুজ বা ওদের বাড়ির লোকজন যতই অভিযোগ করুক না কেন, যুক্তি সম্মত কারণ না থাকলে ওদের ইচ্ছা থাকলেও আইনত ডিভোর্স দিতে পারবে না, উপরন্তু মেয়েটির বাড়ির লোকজন যদি মেয়েটির উপর শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচারের কেস করে দেয় তা হলে সবুজ ও তার বাড়ির লোকজনের জেলের ভাত খেতেও হতে পারে।” এই বলে চঞ্চল বাবার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে”। চিন্তাহরণ খানিকটা হেসে বলে “মেয়ের বাপ যদি গরিব হয় তা হলে থানা কোর্ট এসব থেকে তারা দূরে থাকতে চাই। তা না হলে কি গ্রাম সমিতিতে এসে বিচার চাই , যাই হোক, তুই আজ সভাস্থলে আমার সাথে চল। দেখি তুই এই সমস্যাটার কিরকম সমাধান করিস। আমার কাছে তোর ওকালতি শেখার একটা পরীক্ষাও হয়ে যাবে”। বাবার কথা শুনে চঞ্চল একটু লাজুক দৃষ্টিতে বলে ‘আবার আমায় যেতে হবে ,ওখানে সব বয়োজ্যেষ্ঠ রা থাকবেন’!চিন্তাহরণ স্নেহ স্পর্শে ছেলের কাঁধে হাত রেখে বলেন “আরে ওতো লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই ,’তোর ল নিয়ে পড়ার যথার্থতার একটা বড়ো সুযোগ – সেটা হাতছাড়া করিস না “।নিরুপমা দেবী ওপরের ঘর গোছাতে গোছাতে বাবা -ছেলের শেষ কথোপকথন গুলো শুনে বলেন “ব্যাস! আর কি, এবার বাপ ছেলে মিলে গ্রাম শুদ্ধ মানুষের বিচার করতে বেরিয়ে পরও”। চিন্তাহরণ বাবু স্ত্রী নিরুপমার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলেন ,আরে গিন্নি তোমার ছেলে এখন আর ছোট্টটি নেই- ‘ল’ পরীক্ষা দিয়েছে ,আগামী দিনে ও অন্যের সমস্যা নিয়ে কোর্টে কেস লড়বে,তখন দেখবে সবাই তোমায় উকিলের মা বলে ডাকছে “।বাবা-মায়ের এই বাক্যালাপ শুনে চঞ্চল খানিকটা লজ্জা বশত দোতলার ঘর থেকে নেমে নিচে চলে যায় ।নিরুপমা দেবী মুখে খুশির ভাবটি লুকিয়ে রেখে স্বামীকে বলেন “নাও নাও অনেক হয়েছে আজ গরুগুলোকে খেতে দিয়ে তাড়াতাড়ি স্নান করে আসবে, ছেলেটা অনেক দিন বাদে বাড়ি এসেছে ,আমিও তাড়াতাড়ি রান্নাটা সেড়েনি ,সবাই আজ একসাথে খাবো” ।
দুপুরের খাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে চিন্তাহরণ চঞ্চল কে নিয়ে সভাস্থলের উদ্দ্যেশে রওনা দেন ।অনেক আগে থেকেই অভিযোগকারী পরিবার আর অভিযুক্ত পরিবার ,পাড়ার অন্যান্য গুণী জনেরা এসে গিয়েছিলেন,যারা অন্যের সমস্যা দেখে দর্শনার্থীর ভূমিকা নেন তাদের ভিড়ে কোলাহল ও যথেষ্ট ছিল ,চিন্তাহরন বাবু আর তার ছেলে কে আসতে দেখে সবাই একেবারে নিঃশ্চুপ হয়ে গেল । গুণীজন বর্গের মধ্যে একজন ষাটোর্ধ ব্যক্তি বললেন আরে চিন্তাদা তোমার ছেলেও এসেছে দেখছি ,বাঃ ভালোই হয়েছে ,ও তো শিক্ষীত ছেলে শুনেছি আইন নিয়ে পড়াশোনাও করছে ,একটা যুক্তিযুক্ত পরামর্শ ওর কাছে পাওয়া যাবে ।চিন্তাহরণ বাবু বললেন আজ তো সেই কারণেই ওকে নিয়ে আসলাম,আমরা আজ দর্শক আর শ্রোতার ভূমিকাই পালন করবো- কি বল সবাই ?সভা স্থলের অন্যান্য মাতব্বররা একযোগে বললো হ্যাঁ হ্যাঁ আমাদের ও মত থাকলো ,দু একজন বেমত থাকলেও প্রোকাশ করলো না কারণ তারা যে তিনদিন ধরে কোনো সমস্যার ই সমাধান করতে পারেনি ।সবুজ কিন্তু ছোট বেলার বন্ধুকে দেখে একটু লজ্জায় পেয়ে গেলো ,ওর মুখ দেখে চঞ্চল বেশ বুঝতে পারলো ,”কিন্তু কেমন আছিস এই কথা জিজ্ঞাসা করা প্রাসঙ্গিক হবে না বলে দুই পরিবারের কর্তা দের বললো আপনারা এক- এক জন করে বলুন আপনাদের সমস্যাটা কি”?প্রথমেই সিধু মন্ডল( সবুজের বাবা) বললো” আমরা কিন্তু বাপু ঐ বউ কে আর ঘরে রাখতে চাই না ,যে কিনা শুধু ফোন কেই ভালো বাসে ,দায়িত্ব জ্ঞান বলে কিছু নেই,জ্ঞানহীনতার জন্য নিজের বাচ্চাটাকে মেরে ফেললো,ঐ ফোন নিয়েই ও বাপের ঘরে থাকুক”।সাথীর বাবার দিকে তাকিয়ে চঞ্চল বললো হ্যাঁ এবার আপনি বলুন। সাথীর বাবা চঞ্চলের দিকে হাত জোড় করে কিছুএকটা বলার আগেই চঞ্চল বলে উঠলো না না ‘আপনি বয়োজ্যেষ্ঠ আপনার হাত জোড় করার প্রয়োজন নেই আপনি বলুন’।সাথীর বাবা একটু কাঁদো কাঁদো ভাবে বলেন আমার মেয়েটা ভুল করেছে,কিন্তু ও ইচ্ছা করে কিছু করে নি তুমি বল বাবা- ”মা কি তার সন্তান কে ইচ্ছা করে মেরে ফেলতে পারে !যে দুর্ভাগ্য জনক ঘটনাটা ঘটেছে তার জন্য তো ওকে সাড়া জীবন অনুতাপ করতে হবে ,তার উপর শশুর বাড়ি থেকে যদি বিতাড়িত হয়, ওর এই জীবন- মৃত্যুর সমান হয়ে যাবে, আমদের ও গ্রামে বসবাস করা দুস্কর হয়ে যাবে ,দেখো এই কটা দিনে আমার মেয়েটা সন্তান হারিয়ে কেমন আধমরা হয়ে গেছে “।চঞ্চল এক ঝলক সাথীর দিকে তাকিয়ে দেখে সদ্য সন্তান হারানো মা শোকে- দুঃখে যেনো জড়োপদার্থে পরিণত হয়ে গেছে আর সবুজ যেন একটা চাবি দেওয়া পুতুলের মতন দাঁড়িয়ে, ওকে যত টুকু বলার অনুমতি ওর পরিবার দিয়েছে ততটুকুই ও বলবে।এমন সময় সিধু একটু উত্তেজিত ভাবে ওর ছেলের দিকে তাকিয়ে বলে ” তুই চুপ করে আছিস কেন ,বল আমি ওর সঙ্গে আর সংসার করবো না(সাথীর দিকে ইশারা করে)”। চঞ্চল কিন্তু এবার একটু বিরক্ত হয়ে বলে- “সিধু কাকা সংসার যে ও করবে না সেটা কি তুমি বলে দেবে,মানছি তোমরা তোমাদের প্রিয় নাতি কে হারিয়েছ তা বলে একটা ভুলের মাসুল আর একটা ভুল -এটা বাঞ্ছনীয় নয় ,আর আমার সবুজকে কিছু জিজ্ঞাসা করার আছে ,সবুজ তুই বলতো সাথীর কি বিয়ের আগে বাপের বাড়ি থেকেই ফোনের নেশা ছিল?এই কথা শুনে সাথীর বাবা বলে বাবা আমরা গরিব মানুষ মেয়ে কে ফোন কিনে দেওয়ার ক্ষমতা কি আমাদের আছে। ভদ্রলোকের মুখের কথা শেষ না হতেই,”না না মেসোমশাই আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করি নি আমার বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেছি” এই বলে চঞ্চল সবুজের দিকে ইশারা করে । সবুজ এবার খানিকটা অপ্রস্তুতের মধ্যেই বলে আসলে আমি ওকে ফোনটা কিনে দিয়ে ছিলাম।”কেন ও কি তোর কাছে জোর করেছিল?এই বলে চঞ্চল সাথীর দিকে ইশারা করে”।আগুন কিন্তু একটু লাজুকতার সাথে বলে না না-মানে! এই বলে চুপ করে যায় ।”তোকে কিন্তু চুপ করে থাকলে হবে না ,তুই ওর স্বামী, তোকে সত্যিটা বলতে হবে এই বলে চঞ্চল সবুজের কাঁধের উপর আলতো করে হাত টা রাখে”।সেই কোন ছোট বেলায় একসাথে স্কুলে পড়লেও অনেক দিনই ওদের মধ্যে কথা হয়নি তার উপর ও অনেক লেখাপড়া করেছে তবুও চঞ্চলের এতটুকু অহংকার নেই এই কথা ভেবে সবুজ বন্ধুর প্রশ্নের উত্তরে বলে “আসল ব্যাপারটা হলো সাথী যখন সন্তান সম্ভবা, ও এই খবরটা আমায় দিলো তখন আমি আবেগ বসতো ওকে বলি যদি আমার ছেলে হয় তা হলে আমি ওকে একটা স্ক্রীনটাচ ফোন কিনে দেব,আর কথা মতন ছেলে হওয়ার দুমাস বাদে আমি একটা ফোন কিনে দিয়ে ছিলাম”।”তুই যেটা বলেছিস বা করেছিস সেটা স্বাভাবিক ভাবে অনেক স্বামীই করে থাকে,কিন্তু ফোন কেনাই তখন কাকা বা কাকিমার অমত ছিল”?এই বলে চঞ্চল সিধু মন্ডলের দিকে তাকায় “।হাঁটে হাড়ি ভাঙার মতন অবস্থায় পড়ে সিধু খানিকটা উত্তেজিত হয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে বলে- “তা বলে কি আমরা বলেছিলাম তোর বউ সারাদিন ফোন নিয়েই বসে থাক, আর কোনদিকে নজর না রাখুক”।’না কাকা তা যে তোমরা বলতে পারো না এ কথা এখানকার প্রত্যেকেই বুঝতে পেরেছে কি বলুন সবাই’,এই বলে চঞ্চল অন্যান্য মাতব্বর দের দিকে ইশারা করে’।এতক্ষন চিন্তাহরণ এর ছেলের বিচক্ষণতার পরিচয় উপস্থিত ব্যাক্তিবর্গরা বুঝে গিয়েছেন,তাই তারা কথা না বাড়িয়ে বললো -‘ভাইপো এটা তুমি ঠিকই বলেছো ‘।চঞ্চল লক্ষকরে সিধু কাকার যেন এই কথাটা বেশ পছন্দই হয়ে ছে,সময় নষ্ট না করে চঞ্চল বলে শোনো সবাই এই মেয়েটি অত্যন্ত গরিব ঘরের ,ও এই আধুনিক প্রযুক্তির ফোন হাতে পেয়ে একটু বেশিই দিশাহারা আর মোহগ্রস্থ হয়ে পড়েছিল ,তাই ছেলেকে নিয়ে যখন ছাঁদে ছিল বেখেয়াল বশতঃ এই দুর্ঘটনাটি ঘটে যায় ,ও তো মা ,এই পৃথিবীর কোনো মায় ইচ্ছাকৃত ভাবে এটা করে না, is an accident, so এই অপরাধের জন্য যদি ওকে শাস্তি পেতে হয় তা হলে তো ওকে ফোন কিনে দেওয়া আর ফোন কিনে দেওয়ার জন্য যারা মত দিয়ে ছিল তারা প্রত্যেকেই দোষী ,কারণ আইন বলে যদি কেউ খুন করে আর তার খুনের পেছনে যারা মদদ দাতা তারা প্রত্যেকেই সমান দোষী। এতক্ষন চিন্তাহরণ ছেলের ওকালতি শিক্ষার যথার্থতা নির্বাক হয়ে সব লক্ষকরছিল, এবার সিধু মন্ডলের দিকে তাকিয়ে বলে -কি হে সিধু, তোমার কি এবার কিছু বলার আছে ? সিধু মন্ডল হকচকিয়ে গিয়ে বলে ‘না না আমি আর কি বলবো ,ছেলে যদি সংসার করে আমাদের আর কি আছে’! চিন্তাহরন বলেন “তোমার ছেলের সংসারে তোমার অবশ্যই বলার আছে কারণ ঐ বউটির সম্পর্ক শুধু তোমার ছেলের সাথে নয়,তুমি ওর শশুর আর তোমার স্ত্রী ওর শাশুড়ি যাদের সঙ্গে এই মেয়েটিকে দিনের বেশির ভাগ সময় টুকু কাটাতে হবে ,ঈশ্বর তোমাদের কপালে এমন একটা দুর্ভাগ্য পূর্ণ ঘটনা লিখেদিয়েছেন এর জন্য আর বউকে দোষী করো না ,ওকে ক্ষমা করে দাও”। এতক্ষন সাথীর সামনে যে কত কথা হয়ে গেলো ও কিন্তু লজ্জায় নিজের প্রতি নিজের ঘৃনায় এক জড়ো পদার্থের মতন মাথা নিচু করে বসে ছিলো ,’ক্ষমা করে দাও ‘এই কথাটি শোনার পর সভাস্থলেই হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললো । সন্তান হারা মায়ের কান্না যে এত হৃদয় বিদারক তা ওই বিচার সভায় উপস্থিত প্রত্যেকেরই চোখের কোনায় এক ফোঁটা হলেও জল এনে দিলো।সিধু কিন্তু আর রাগ করে থাকতে পারল না ,একটি মাত্র ছেলের বউ তার,সেও তো বৌমা কে খুব ভালো বাসতো ,শুধু মাত্র বৌমার বেখেয়াল বশতঃ নাতির মৃত্যুর কারণে খুব রাগ হয়েছিল তার ।সিধু সাথীর হাত দুটো ধরে বললো “আর কাঁদিস না মা ,আমাদের ভাগ্যে এই কষ্টটা ছিল,তোকে আমরা আর কিছু বলবো না- চল মা বাড়ি চল “।চিন্তাহরণ বাবু বললেন ‘কি সবুজ তোমার কি মত’। ছেলের মতামতের কথা শুনে সিধু আবেগতাড়িত হয়ে বললো “ওর ঘাড়ে কটা মাথা আছে ও মত দেবে, আমার বৌমা আমি বলছি ও আমার সাথেই বাড়ি যাবে”।এই বলে সিধু সভাস্থলে সবাইকে আমরা তা হলে আসছি বলে নিজের বৌমা কে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেয়। সবুজ চঞ্চলের হাত ধরে বলে ভাই আমার ভুল হয়ে গেছে আমি সবার কাছেই ছোটো হয়ে গেলাম ।”আরে না না পরিস্থিতির চাপে পরে তুই যে এটা করেছিলি সেটা আমি আগেই বুঝেছিলাম,যায় হোক ভবিষ্যতে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একটু ভেবে নিবি,যা- যা এখন বাড়ি যা এই বলে চঞ্চল বিচার সভা থেকে বাড়ি যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেই ।এমন সময় সাথীর বাবা চঞ্চল কে বলে ,”বাবা আমি কি বলে যে তোমাকে ধন্য বাদ দেব,তোমার জন্য আমার মেয়েটা আবার সংসার করতে পারল,তোমার এই ঋন আমি কোনো দিনই ভুলবো না”।”না না মেসোমশাই এতে আমার কোনো কৃতিত্ব নেই,এখানে যারা বয়োজ্যেষ্ঠরা আছেন অনারাই এই কৃতিত্বের অধিকারী আমি শুধু একটু ভুলটা ধরিয়ে দিয়েছি,তবে সবার উদ্দেশ্যে আমার একটা কথা বলার আছে সেটা হলো -আধুনিক প্রযুক্তিতে যায় আবিষ্কার হোক না কেন তার ব্যবহার কিন্তু শুধু মাত্র প্রয়োজন মতো আর সঠিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা উচিত তা না হলে এরকম দুর্ঘটনা বার বার হবে “এই বলে চঞ্চল সবাইকে প্রনাম জানিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয় ।চিন্তাহরণ ও স্ত্রী কে ছেলের এই বুদ্ধিমত্তার খবরটা বলবে বলে সবাইকে বিদায় জানিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়ায় ।এত দিন তো গ্রামের সবাই চিন্তাহরণ এর বিচার কৌশল দেখেছে আজ তার ছেলেরও বিচার কৌশল দেখলো । আর সবাই একটাই কথা বলতে লাগলো “বাপ কা বেটা সিপাহী কি ঘোড়া ,কুছনা হোগা তব ভী থোৱা থোৱা”।
–~০০০XX০০০~–