“ক্লিওপেট্রা”
✍ ইন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
(চতুর্থ পর্ব)
অ্যান্ড্রোমিডা আর মিনার্ভা। রাণীর দুই দাসী। রাণী জানেন এরা নিজেদের থেকেও রাণীকে ভালোবাসেন। প্রাসাদে যেখানে দেবী আইসিসের মূর্তি আছে তার দক্ষিণ পূর্ব কোনে রাণীর বিশাল স্নান ঘর। দ্বারস্থ সিংহমূর্তি টলেমাইন বংশের ঐতিহ্য। লাল রঙের দেওয়ালে অসম্ভব কারুকাজ। রাণীর জন্মের তিনশ বছর আগে এই প্রাসাদ তৈরি। সৌন্দর্যের রাণীর স্নানের তোড়জোড় চলছে।
মিনার্ভা রাণীর প্রাসাদে এসে তার গা থেকে অলঙ্কার গুলো খুলতে শুরু করলেন। ফ্যারাও দের শিরোস্ত্রান রাখতেই হবে। প্রশাসন কালে চুল ঢেকে রাখতেই হবে। ভীষণ অশুভ এই চুল।
মিনার্ভা কায়রোর মেয়ে । ভীষণ দারিদ্র্য লাঞ্ছিত পরিবারে ওর জন্ম হয়েছিল ।আজ তারা স্মৃতিতে ।বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক রাখা মিশরে নিষিদ্ধ ।তাই টাকার বিনিময়ে এক ধনী ইউরোপীয় তাকে শুধুমাত্র গ্ৰীষ্মকালের স্ত্রীর মর্যাদায় বিবাহ করতে চায় ।ষোড়শী মিনার্ভাএই অন্যায় নোংরা প্রস্তাবে রাজী হয়নি ।যখন সকলে মিলে তার উপরে অত্যাচার চালাচ্ছিল ঠিক তখনই ওর ভালোবাসার মানুষ মুরসিয়া ওকে নিয়ে পালিয়ে আসে আলেকজান্দ্রিয়া তে ।ভাগ্যের সন্ধানে যখন এদিক ওদিক ঘুরছিল তখন অ্যান্ড্রোমিডা ওদের প্রাসাদে আনে ।রাণী খুব খুশি হন ।মুরসিয়া আর মিনার্ভাকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করেন ।রূপচর্চার জন্য সাতশ গাধার দেখভাল করার কাজ দিলেন মুরসিয়া কে ।আর দাসী করলেন মিনার্ভাকে।
মুরসিয়া স্নান ঘরে গাধার দুধ দিয়ে গেছে ।অন্যান্য দাসদাসীরা এনেছে ডিম,মধু ।সামুদ্রিক লবন নিয়ে অ্যান্ড্রোমিডা স্নান ঘরে এলো ।
একটি রূপার পাত্রে ডিমগুলোর সাদা অংশ ফেটিয়ে মিশ্রন তৈরি হয়েছে ।প্রাসাদ সংলগ্ন উদ্যান থেকে ঘৃতকুমারী সংগ্ৰহ হয়েছে ।ভেষজ গাছ গাছড়া নিয়ে আসা হয়েছে যা দিয়ে তৈরি হবে রূপচর্চার সামগ্ৰী ।এসেছে কমলালেবুর খোসা ।মিনার্ভা নিয়ে আসছেরূপের রাণীকে ।সকলেই তটস্থ ।উনি তো শুধুমাত্র রাণী নন ,টলেমিয়ান বংশের ফ্যারাও ।বিশ্বের তাবড় তাবড় নামজাদা রাজার হৃদয়েশ্বরী ।
স্নানাগারে একটি সুদৃশ্য আসনে বসলেন ক্লিওপেট্রা ।অ্যান্ড্রোমিডা রাণীর অনুমতি নিয়ে শুরু করলে প্রসাধনী চর্চা ।সব জিনিস ই প্রাকৃতিক ।প্রকৃতির মধ্যেই লুকিয়ে আছে রূপের রহস্য ।এই ভেষজ গাছ গাছড়া আগে মিশরীয় পুরোহিত রা নিজেদের দখলে রেখেছিল ।রাণী তা মানেন নি ।কেড়ে নিয়েছেন ওদের সেই ক্ষমতা ।এ নিয়ে সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে অশান্তি ও দমন করেছেন ।
সুদৃশ্য পাথরের তৈরি স্নানের টাবে সাতশ গাধার দুধ ঢেলে গেছে মুরসিয়া ।মিনার্ভা তাতে মধু ঢাললো ।তারপর এল বাদাম তেল ।উপরে ছড়িয়ে দেওয়া হল গোলাপের পাপড়ির নির্যাস ।অপূর্ব এক সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়লো গোটা প্রাসাদে ।
অ্যান্ড্রোমিডা রাণীর অনুমতি নিয়ে সেলাম ঠুকে রাণীর মাথায় হাত দিল।পরম মমতায় রাণীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে ।চুলে বিলি কেটে কেটে ঘষতে লাগলো ডিমের সাদা অংশ ।বেশ কিছুক্ষণ এরকম করার পর গাধার দুধের পাত্রে অবগাহন করলেন রাণী ।মিনার্ভা একটি বড়ো পাত্রে সামুদ্রিক লবনের সাথে মধু মেশালেন ।দুধে ভেজা নরম তুলতুলে শরীরে দুই প্রিয়তমা দাসী ওই মিশ্রন দিয়ে গাত্র মার্জনা করতে লাগলেন ।গাধার দুধে চর্বি এত বেশি যে শরীরকে ঔজ্জ্বল্য দান করে ।এর পর চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত ঘৃতকুমারীর প্রলেপ দেওয়া হল ।এর সাথে মুলতানি মাটির প্রলেপ দেওয়া হল ।তারপর গোলাপের নির্যাস দিয়ে ঘষে ঘষে তোলা হল ।এমন স্নানে তরতাজা হয়ে উঠলেন রাণী ।দুই দাসীর দিকে ছুঁড়ে দিলেন দুইছড়া মুক্তার মালা ।শেষে কমলার রসে ভেষজ মিশিয়ে মুখখানি ধুয়ে নিলেন রাণী স্বয়ং ।রাণী স্নান সমাপন করে প্রাসাদে নিজ কক্ষে গেল ।
সূর্যাস্তের পর ইলিয়াড পড়ছিলেন সম্রাজ্ঞী ।প্রেম ।হেলেন আর প্যারিসের প্রেম আগুন লাগিয়ে দিয়েছে ট্রয় নগরীতে ।প্রেম মানেই আগুন ।দেবীদের মধ্যেও ঈর্ষা কম নাকি ।গ্ৰীক পুরাণে তিন দেবী সৌন্দর্যের লড়াই করলো ।বলিহারি!হেরা আর এরিসকে বাদ দিয়ে প্যারিস কী কুক্ষণে আফ্রিদিয়াকে সুন্দরী শ্রেষ্ঠ বলেছিল ।আর পরিণাম হাতে নাতে ।তবে কী রূপ অভিশাপ ।নিজেকে ভালো করে দেখলেন ।কত জ্ঞান ভান্ডারে নিজেকে সমৃদ্ধ করেছেন দিনের পর দিন ।বড়ো আশ্চর্য নিয়ম টলেমিয়ান বংশের ।বয়সে ছোটো ভাই দের সাথে বিয়ে ।নিয়ম নিগড়ে প্রেম হয় ?বয়সে একত্রিশ বছরের বড়ো জুলিয়াস সিজার তাকে ভালোবেসেছেন ।সবাই তাই বলে ।কিন্তু সাম্রাজ্য দখল করতে গেলে সিজারকে তুরুপের তাস বানাতেই হত ।সিজারের সন্তানের মা হয়েছেন ।দিনের পর দিন শারীরিক সম্পর্ক থাকবে অথচ মন অবিকৃত থাকবে তাও কী সম্ভব !কত কথা মনে হচ্ছে আজ ।স্মৃতির সরণি বেয়ে পাড়ি দিয়েছেন অতীতে।
রোম।স্বপ্নের নগরী ।চিরকাল এদের সমঝে চলেছেন রাণী ।তাছাড়া কৃতজ্ঞতাবোধ ও কম নয় ।রোমে গৃহযুদ্ধ চলেছে তার জন্মের ও আগে থেকে ।গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হোক কেউ চায় না ।রোমের সেনানায়করা দুর্ধর্ষ বীর ।আর নিষ্ঠুরতার চূড়ান্ত পর্যায়ে বাস করে ।শুধু সিজারের কথা আলাদা ।সিজারের ভরাটি গলা আকর্ষণ করে ভীষণ ।সিজার এর উক্তিটি মনে পড়ে গেল ।”এলাম,দেখলাম আর জয় করলাম”।
দেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষ সিজার কে চায় ।স্পার্টাকাসের নেতৃত্বে দাসেরা বিদ্রোহ করেছে ।এটাও গৃহযুদ্ধের কারণ ।সিজারের প্রতিদ্বন্দ্বী পম্পি আলেকজান্দ্রিয়া তে এসেছে ।সিজারের পক্ষ নিলে মিশরের রাণী হবার সম্ভাবনা প্রবল ।তাই এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করতেই হবে ।
একুশ বছর বয়সে শরীরে তখন যৌবন বান ডেকে যায় ।গ্রীক সেনানায়ক একঝলক দেখেছেন মাত্র ।এত সুন্দর চোখ আর তার নিবিড় আকর্ষণ যেন অস্থির করে তোলে ।বারবার প্রেমপ্রস্তাব পাঠান দূত মারফত ।গল দেশ জয় করেছেন তিনি ।দেশে বিদেশে ঘুরেছেন ।এমন নারী তো দেখেন নি ।এতো সৌন্দর্যের মল্লিকা ।রাণী হবার উপযুক্ত ।
উঠতি বয়সের যৌবন ।এই তো জীবনের সেরা কাল ।সিজারের চোখের ভাষা পড়ে ফেলেছেন সম্রাজ্ঞী ।লোকমুখে শুনেছেন তিনি ক্লিওপেট্রার চিন্তায় বিভোর ।মিশরীয় পুরোহিত রা কিছুতেই রোমানের সাথে বিয়ে মেনে নেবে না ।মিশরবাসীরা তো নয় ই ।এদিকে রোমের আইনে আছে এক স্ত্রী বর্তমানে দ্বিতীয় স্ত্রী গ্ৰহণ নিষিদ্ধ ।শুধু তাই নয় ।কোনো বিদেশিনী কে রোমান রা রাণীর স্বীকৃতি দেবে না ।হতাশ হলেন রাণী ।আবার নিয়ম নিগড়ে বন্দী প্রেম ।না ।আর মানবেন না ।অসম্ভব ।সিজার কে তার চাই ই চাই ।
কৌশলে বাজিমাত করতে হবে ।চতুর আর বুদ্ধিমতি মিশর সম্রাজ্ঞী মনে মনে হাসলেন ।কিছুক্ষণ আগেই এক পারসি যুবক আলেকজান্দ্রিয়া র প্রাসাদে এসেছিল ।বেশ সুন্দর দেখতে ।ওকে একটু কাজে লাগাতে হবে ।ছদ্মবেশে এলেন যুবকটির কাছে ।জানতে চাইলেন ।”এই !কী নাম তোমার?”
যুবকটি জানালো ওর নাম সামির ।রোম থেকে আলেকজান্দ্রিয়া ওর ব্যবসার জায়গা ।জাতিতে পারসি ।পূর্বপুরুষের আমল থেকেই ওরা কার্পেট ব্যবসা করে ।এখানে কার্পেট দেখানো হয়ে গেলে রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজারের শিবির এ যাবেন ।হঠাৎ যুবকটির চোখে পড়ে অপূর্ব লাস্যময়ী এক নারী ।ভাবলে এমন রূপ ।অথচ দাসীর কাজ করে ।একে পেলে বিবি করে রাখবো ।
রাণীর উদ্দেশ্য সফল ।বললেন চলো সামির ।আমি তোমার সাথে পালিয়ে যাই ।
(এরপর… ক্রমশ…)