★সনাতন ★
✍ কর্ণ শীল
———–
“নাম কিরে তোর? “
“সোনাতোন “
“স্কুল যাস না কেন? “
“পোটপোটি কুড়াতে যাই, বাবার জোর আসলো “
পটপটি থেকে খই হয় শুনেছি। সাদা সাদা সুগন্ধি খই। কোনোদিন খাইনি। এদিকে বিশেষ চল নেই বলেই বোধহয় খাওয়া হয়নি। সনাতন সেই যে পটপটি কুড়োতে গেল তার দেড় হাত ঘোমটা টানা মায়ের সঙ্গে, আর বছর দশেক তাকে দেখিনি। এর মধ্যে কত কি ঘটে গেল। পটপটি জন্মাতো যে সব পুকুরে, সেগুলি ভরাট করে বড় বড় ঘর উঠেছে, বা ঘিরে দিয়ে মাছ চাষ শুরু হয়েছে, পোশাকি নাম আঁতুর পুকুর।
এ বছর মনে হলো ওজনটা না কমালেই নয়। মাঠে বা রাস্তায় দৌড়োতে প্রথম প্রথম লজ্জা লাগে, তা ছাড়া পীচ রাস্তায় দৌড়োলে হাঁটু ঝনঝন করে, মাথার পাশের শির ফুলে উঠে টিপটিপ করে। সবচেয়ে সহজ দেখলাম ফুটবল খেলা। প্রথম দিকে জিভ বেরিয়ে আসতো। দু কদম দৌড়ে মনে হতো মাথা ঘুরছে, বুকটা ফেটে যাবে এক্ষুণি। বাঁ পায়ে ভালো পাঞ্চ করতে পারতাম এক সময়। সেই ভরসাতেই প্রথম দিন নেমেছিলাম। লেফট আউটে অফসাইড বাঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। একটা নড়বড়ে শটও করেছিলাম দূর থেকে, বারপোস্ট ছুঁয়ে বাইরে চলে গেল সেটা।
এমন সময় সেন্টার ফরোয়ার্ড থেকে একটা এক টীমমেট দৌড়ে এসে আমাকে বলে গেল,
“কাকা, পিছিয়ে নাও একটু। আমি সাজিয়ে দেবো তোমাকে, তুমি শুধু গোলে রাখবে। “
ছেলেটাকে খুব চেনা চেনা মনে হলো আমার। কিন্তু কোথায় যে দেখেছি কিছুতেই মনে পড়লো না। ওদের একটা গোল কিক আকাশ ছিঁড়ে মাটিতে নেমে আসছিল, ওই ছেলেটা একটু পিছিয়ে দাঁড়ালো বলটা যেখানে আছড়ে পড়বে। সামনে ওদের দু জন ফরোয়ার্ড অপেক্ষা করে আছে, বলটা নেমে এলেই ছেলেটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো।
কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আপাতত কোনো কাজ নেই আমার, এ বল বার করার ক্ষমতা ওই রোগাপটকা ছেলের দ্বারা হওয়ার নয়। ঠিক তখনই ছেলেটা হিলহিলে রোদের রশ্মির মতো ছিটকে উঠলো হাওয়ায়, পড়ন্ত বলটাকে মাটিতে পড়তে না দিয়ে সেটাকে বুকে আটকে নিলো। আর চোখের নিমেষে অপোনেন্টের দুজনের মাঝখান দিয়ে উড়ে বেরিয়ে গেল। সামনে হাফ ব্যাক, ছেলেটা তার দু পায়ের ফাঁক দিয়ে বাঁয়ে বলটা থ্রু পাস করলো,
“কাকাআআআআআ! “
ওদিকে কাকার তখনও বিস্ময় কাটেনি, হাঁ করে চেয়ে আছে সবুজ সীমানা আঁকা হলুদ গেঞ্জিটার দিকে। যখন চমক ভাঙলো, বল সীমারেখার বাইরে। দু হাত তুলে বোকার মতো হাসলাম,
“সরি, মাই ফল্ট …”
ছেলেটা আবার দৌড়ে নেমে গেল মাঝ মাঠে।
ওর চলে যাওয়া দেখেই মনে পড়ে গেল, এ সেই মায়ের সঙ্গে পটপটি কুড়োনো ছেলে।
।। দুই।।
তারপর তো যেমন তেমন করে বর্ষা চলে এলো। পৃথিবী নিজেই ফসল ফলান, নিজেই বর্ষার জল দিয়ে মুখও আঁচিয়ে দেন। আমাদের কয়েকজন সে আপ্যায়ন নিয়ে আরও আলসে হয়ে পড়ি, আরও গরহাজরি বাড়ে কাজকর্মের খাতায়। কিন্তু কয়েক পাগল আছে, যাদের সব চাই। যত রকম খেলা এ বিশ্বে প্রচলিত তার প্রতিটির গায়ে তারা আছড়ে পড়ে, হারে জেতে লাজ নাই, মুখে হাসি। ঘাম মুছতে মুছতে হাসি হাসি মুখে বলে ওঠে, “হ্যাঁ খেলেছি তো বটে। “
এ বর্ষায় ছেলেদের ফুটবলের খুব তোড়জোড়। বিশ পঁচিশ গাঁ উজিয়ে এই পাঁঠা নিয়ে আসছে, এই নিয়ে আসছে দেড় মানুষ উঁচু ট্রফি। আমাদের গ্রামের টীম ফুটবলে বছর তিরিশেক আগে একবার, আর বছর পঞ্চাশেক আগে আরেকবার বেশ উঠে এসেছিল। কিন্তু এত রমরমা, প্রাইজের ঘনঘটা আগে কোনোদিন দেখিনি। এ যেন মা ফুটবলেশ্বরী স্বয়ং আমাদের দিকে মুখ তুলে চেয়েছেন।
মাস খানেক আগে ছেলেরা এসে ধরেছে, কাকা বড় ম্যাচ যেতেই হবে। আমি বেশ লজ্জা টজ্জা পেয়ে বললুম,
“এই না না, আমাকে আবার টানাটানি কেন? তোরাই খেল না। “
ভোম্বল সরলভাবে মাথা নেড়ে বললো,
“আরে, তোমাকে খেলতে হবে না কাকা, তুমি শুধু মাঠের পাশে থাকলেই হবে। “
এদিক ওদিক চেয়ে দেখলাম, –নাঃ, কেউ শোনেনি। গম্ভীর হয়ে বললাম,
“তা খেলা কোথায়? “
“পারুলিয়া স্কুল মাঠে। কাল দুপুর দুটো। “
মাঠ জুড়ে এখন সবুজ ঘাস। গোড়ালি ডুবে যায়, পায়ের পাতা ভিজে যায় শিশিরে। আমরা যখন সে স্কুলে পড়াশোনা করতুম খটখটে শুকনো ছিল মাটি। একটু ছোটাছুটি করতে গেলেই পা ব্যথা করতো। আর আছাড় খেলে তো কথাই নেই। হাঁটু কনুইয়ের অবস্থা সঙ্গীন হয়ে দাঁড়াতো।
তাও তো খেলতাম।
পূবে কার যেন আমবাগান ছিল, তাতে দুপুর রোদে আম কুড়োনো হতো, একটা বিরাট শিরীষ গাছ ছিল পূব দক্ষিণ প্রান্তে, ছাতিম ছিল পশ্চিমের গেটের কাছে, বাউন্ডারি ওয়াল ছিল না এত উঁচু। এখন সে সব গেছে। চারটে বিশাল বিশাল স্কুলবাড়ি। ওই একই সীমানায় রয়েছে দুটি দোতলা প্রাইমারী স্কুল।আমি অবাক হয়ে ভাবি, এই বিরাট বিরাট কংক্রিটের বাঁধনের মধ্যেও রসিক ঘাস তার রসের উৎস্রোত খুঁজে নিলো কি করে!
প্রকৃতি ভারসাম্য ঠিক বজায় রাখে। একদিকে তার প্রাচীর যেমন গড়ে ওঠে, অন্য দিকে তার বুকে নিত্যনতুন সবুজ জন্ম নেয়। কখনও তা চোখে পড়ে, কখনও নিরালায় ভারি পূর্ন হয়ে ওঠে প্রচারের অন্তরালেই।
দুুপুর দুটো নাগাদ পৌঁছে দেখি ছেলেরা মনমরা। ছোটকা অলসভাবে পায়ে ক্রেপ জড়াচ্ছে, আবার খুলে ফেলছে। ভোম্বল চিত হয়ে শুয়ে দাঁতে একটা ঘাসের গোড়া কাটছে। হীরু ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো,
“কাহে মেচ দেলকো, না আইবি যব? “
ছোটকা তেড়ে উঠলো,
“গেছে কোথায় ফাঁকিবাজটা? “
হীরু একটা শুকনো ডাল হাতে নিয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেললো,
“আলু তুলনে “
ছোটকা লাফিয়ে উঠলো,
“চল তো, আমরাই খেলবো। কি হবে, হারবো তো? হারলে হারবো! “
আমি জিজ্ঞাসা করলাম,
“কার কথা বলছিস? “
ভোম্বল মিনমিনে গলায় বললো,
“সনাতন “
।। তিন।।
সরডাঙার সাঁওতাল মিশনারিদের টীমটা যেমন পরিপাটি তেমন শক্ত। সুফল আর বিশাই নামে ওদের দুটি উইং তো বিদ্যুৎ। আশ্চর্য ছক ওদের। সেভেন সাইড খেলা বলে মাঠও ছোটো।
খেলা শুরুর ত্রিশ সেকেন্ডের মাথায় বিশাই লেফট উইং থেকে বল রিসীভ করে সাঁ সাঁ করে নিজেদের হাফের কর্ণারে নেমে গেল। আমি অবাক। এমন খেলা তো কোনোদিন কোথাও দেখিনি। আমাদের পাঁচটা প্লেয়ার বাঘের মতো ছুটে গেল তার দিকে। বিশাই বাঁ পায়ের একটা জোরালো চিপে বলটা রাইট উইংয়ের উদ্দেশ্যে ভাসালো।সুফল বলটা বুকে নিয়ে ছোটখাটো ভোম্বলের মাথার প্রায় উপর দিয়ে সোজা গোলে ঢুকে গেল।
দর্শক ফেটে পড়লো। এমন একটা আশ্চর্য গোল দেখেও মনটা দমে গিয়েছিল। যতই হোক নিজের গ্রামের দল গোল খেয়েছে বলে কথা। বাকি হাফটা পলাশপুলী ডিফেন্স করেই কাটালো। রেফারির বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গে একটা চিৎকার শুনতে পেলাম আমাদের টেন্টের দিক থেকে,
“হীরু গে, জার্সি দে গে “
এই তো সেই ছেলেটা। সেদিন হলুদ গেঞ্জি পরে ছিল। হাঁটুতে ধুলো, মুখে চুলে ধুলো। হীরু দৌড়ে গিয়ে জার্সিটা দিলো ওর হাতে। চটপট জার্সিটা বদলে ঢকঢক করে জল খেয়ে নিলো ছেলেটা। ভোম্বল ওর কাছে গিয়ে বললো,
“কিছু খাবি সনাতন? “
সে হেসে বললো,
“তোরা তো খেয়েছিস, আমি খাওয়াবো। “
সেকেন্ড হাফের বাঁশি বাজলো। সনাতন ঘাসে চুমু খেয়ে মাঠে নামলো।পায়ের ক্রেপটা পুরো জড়ানো হয়নি। ঝুলঝুল করছে সেটা। সেন্টার থেকে বলটা ছোটকা সনাতনকে ঠেললো।
বলটা ছেড়ে দু পা পিছিয়ে এসেই একটা ভলি তুললো ছেলেটা। বিপক্ষের বারপোস্টের অনেকটা বাইরে। ওদের গোলকীপার হাসলো দাঁত বার করে। আমার চোখ সরেনি একটুও বল থেকে। সনাতনের বাঁ পায়ের চেটোর বাঁকা কোণাচে ভাবটা আমি দেখেছি শট নেওয়ার সময়। বলটা একটা সাদা কালো শিকারী পাখির মতো শূন্যে কিছুক্ষণ গ্লাইডিং করে সোঁ করে নেমে এলো সরডাঙার জালে।
ভোম্বল ছোটকারা আনন্দ করতেও ভুলে গেল যেন। সনাতন পায়ের ক্রেপটা বাঁধতে বাঁধতে ওদের দিকে চোরা হাসি নিয়ে তাকিয়ে রইলো কয়েক সেকেন্ড। পুরো মাঠ গর্জনে ফেটে পড়লো।
পায়ের নীচে ঘাস পড়লে সনাতন বিষাক্ত সাপ হয়ে ওঠে, ধারালো চিতা হয়ে ওঠে। বাকি খেলা একটা চার ফুট তিন ইঞ্চির নীল জার্সি দাপিয়ে বেড়ালো। খেলার রেজাল্ট পলাশপুলী ৪ – সরডাঙা ১। বিশাই আর সুফল খেলার শেষে জড়িয়ে ধরলো সনাতনকে।
“এত ধুলো কেন তোর গায়ে? ”
“আলু কুড়োতে গিয়েছিলাম। মাঠে খুব ধুলো। “
সনাতনের কাঁধ চাপড়ে ওরা চলে গেল।
আমি খুব সঙ্কোচের সঙ্গে ওর কাছে গেলাম।
“তোর ফোন নম্বরটা দিবি সনাতন? “
“হ্যাঁ কাকা, নাও না। কি করবে নিয়ে? “
নামটা সেভ করে ওকে একটা মিসড কল দিলাম। বললাম,
“এটাই হোয়াটস অ্যাপ নম্বর আমার। তোর একটা ছবি পাঠাবি? “
সে একটু ভেবে নিয়ে বললো,
”কয়েকদিন তো ফোনে ব্যালেন্স নেই কাকা। সন্ধ্যাবেলায় আলু তোলার টাকা পাই, তারপর পাঠাবো, হ্যাঁ? “
আমি মাথা নেড়ে চলে এলাম রে সনাতন। তোকে বলার সাহস হলোনা, এ কটা টাকা তো, আমিই রিচার্জ করে দিই। সনাতনদের কিছু দেওয়া যায় না। আমরা যারা অতি সাধারণ, অতি নগণ্য, ওই যাদুতে বিহ্বল হয়ে থাকতে পারি শুধু।
আর যাদুকর ভেবে বসে থাকে, এমনটা যেন খুব সহজ, এমনটা যেন সবাই পারে।
–~০০০XX০০০~–
ভাই কর্ণ তোর সনাতন গল্পটা ছবির মতো চোখের সামনে ভেসে নিয়ে গিয়ে ফেলল সেই ছোটোবেলায়। হারিয়ে গিয়েছিলাম কিছু সময়ের জন্য।