“বন্ধু”
✍ সলিল চক্রবর্ত্তী
“ভগা, এবার যদি কারোর গাছে উঠে আম পাড়িস, আর কেউ যদি বাড়ি বয়ে এসে নালিশ করে যায়, তবে তোকে ঠিক বোর্ডিং-এ রেখে আসবো। দেখবি কেমন মজা।” মা শাষনের সুরে ভগাকে উদ্দেশ্যে করে কথাগুলো বললেন।
ভগা ওরফে ‘ভগবান বসু’। বংশের প্রথম নাতি, তাই দাদু ঈশ্বরের সাথে নাম মিলিয়ে ‘ভগবান’ নাম রেখেছেন। বতর্মানে বাড়ি এবং পাড়ায় এমনকি স্কুলেও মাস্টার মহাশয় ছাড়া ‘ভগবান’ নাম অপভ্রংশ হয়ে ‘ভগা’-তে পরিনত হয়েছে। ও এতো বিচ্চু যে ‘ভগবান’ বলে কারোর ডাকতেই ইচ্ছা করে না। হয়ত ওকে ‘ভগবান’ ডাকলে ভগবান কেই ছোট করা হবে।
গাংনাপুরের সেজদিয়া গ্রামে অনিল বসুর পৈতৃক ভিটে। অবস্থাপন্য না হলেও সজ্জন ব্যক্তি হিসাবে পাড়ায় নাম আছে। ভগা অর্থাৎ ভগবান বসু গাংনপুর হাইস্কুলের ক্লাস সেভেনের ছাত্র। ছোট ভাই প্রবীর ও বিজয় সেজদিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে। তারা বেশ শান্তশিষ্ঠ। (ভগা হাইস্কুলে পড়াতে একমাত্র স্কুল থেকে রিপোট আর প্রতিবেশির নালিশ ছাড়া তার দৌড়াত্ব বাড়িতে ঠিকঠাক জানতে পারতো না।)
মা ভগাকে চালের কাঁকর বাছতে দিয়েছেন। ভগা চালের কাঁকর বাছতে বাছতে ঠাকুরমার সাথে গল্প করছে। আজ নাকি পাশের পাড়ায় পেঁচো, ঠাকুরদার পেয়ারা গাছে পেয়ারা পাড়তে উঠেছিল। পেঁচো পেয়ারা পাড়তে পাড়তে গাছ একদম মগডালে উঠে পড়েছে। তারপর সেই ডাল পেঁচোর ভার রাখতে না পেরে বেঁকে নিচের দিকে কাত হয়ে পড়তে থাকে। ততক্ষণে সবাই টের পেয়ে গেছে। পেঁচোকে তখন ধরে মারবে কি ! সবাই তখন হায় হায় করছে যাতে ও নিচে পড়ে মারা না যায় ! ঠাকুমা ফোকলা দাঁতে বিস্ময়ের জানতে চান তার পর কি হল ? ভগা চাল বাছা বন্ধ করে ঠাকুরমার দিকে তাকিয়ে চোক দুটো পাকিয়ে সাসপেন্সটা বর্ননা করতে থাকল। “পেয়ারা গাছের নিচে ছিল চিচিঙ্গার মাচা আর সেই ডাল ভেঙে এসে পড়ল মাচার উপর। আর তাতেই রক্ষে”। অনিল বাবু একটা কচার ডাল ভেঙে এনে ভগার পাছায় কটা বাড়ি মেরে বলেন “জানোয়ার পেঁচো পড়ে মরছিল ?” ভগার পাছায় কচার বাড়ি পড়ায়, ভগা “বাবাগো” বলে এক লাফে মাঠের দিকে দৌড়। পরে জানা গেল পড়ে মরছিল পেঁচো নয় ভগা নিজেই। নিজের বিপদের কথা পেঁচোর উপর দিয়ে চালাচ্ছিল।
ভগা বড়দাদা, সুযোগ পেলেই শান্ত দুই ভাইকে একটু শাষন করে নেয় আবার শিক্ষাও দেয়। যেমন অনিলবাবু বাজার থেকে পনির কিনে এনেছেন। ছোট দুইভাই কয় পিস পনির খাবে তাই নিয়ে খুব উৎসাহিত। ছোট ভাই উচ্চারণ ভুল করে বলছে “আমি চার পিস ফনি খাব” পাশে বসে অঙ্ক করছিল ভগা বিজ্ঞের মত মাথা তুলে ভাই-এর দিকে তাকিয়ে বললো “কথাটা ফনি নয় পনি। মনে থাকবে – প -নি” আবার বাবা হয়ত তিন ভাইকে পড়াতে বসিয়ে একটু এদিক ওদিক গেছেন সঙ্গে সঙ্গে ভগা দুই ভাইকে শাষন শুরু করে দেবে। পারলে দুই একটা চড় চাপড় মেরে বাবার কাছে নিজে খাওয়া চড় চাপরটা উশুল করে নেয়।
ক্লাস টিচার অশোক মাষ্টারকে ভগার একদম পছন্দ নয়। শুধু বকাবকি করবেন আর ফাষ্টবয় অরিন্দমের সঙ্গে তুলনা করবেন। ইংরেজি বাংলা মিশিয়ে কথা বলবেন যা বুঝতে ভগার খুবই অসুবিধা হয়। অরিন্দমের হাতের লেখা ভাল, অরিন্দম রোজ পড়া করে স্কুলে আসে, অরিন্দম আশি শতাংশ নম্বর পায় আরও কত কি। ভগা ভেবে পায় না উনি এমন করেন কেন? অরিন্দম মন্ডল আর ভগবান বসু কি এক? পার্থক্য তো থাকবেই, এতে এতো বলার কি আছে ! একদিন মনের কথাটা পাশে বসা বিলেকে ভগা বলে দিল। পেট পাতলা বিলে সেটা আবার অশোক মাষ্টারকে বলে দেয়। অশোক মাষ্টার বিলের মুখ থেকে কথাটা শুনে ভগাকে ব্যাঙ্গ করে বলেন, “কি হে ভগবান বোস তুমি একটু অরিন্দম হয়ে দেখাওনা। অরিন্দম কিন্তু ইচ্ছা করলেই তুমি হতে পারবে”। ভগার ক্ষোভ আরো বেড়ে যায়। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে সুযোগ যদি পায় তো অরিন্দমকে ভগা করেই ছাড়বে।
স্কুলে যাওয়ার সময় ভগা কখনই সময় মত তৈরি হয় না। ওর সহপাঠি রতন এসে রোজ দাড়িয়ে থাকে। দুজনে এক সাথে স্কুলে যায়, আবার ফেরেও এক সাথে। ভগার কিছু দুষ্টুমি বাড়ির লোক রতনের থেকেই জানতে পারে।
একদিন স্কুল ছুটির পর ভগারা কয়েক জন বন্ধু মিলে বাড়ি ফিরছে। এর মধ্যে এক আইসক্রিম ওয়ালা এসে পড়ায় সবাই টিফিনের পয়সাতে আইসক্রিম কিনে খেতে শুরু করল। পারলনা ভগা কারন ওর পয়সা স্কুলে ঢোকার আগেই ঘুগনি খেয়ে শেষ করে ফেলেছে। গরমের দিনে ঠান্ডা আইসক্রিমের মজাই আলাদা। কিন্তু ভাগ দেওয়া খুব মুশকিল। ভগা আইসক্রিম ওয়ালার কাছে একটা আইসক্রিম বাকি চায়। কিন্তু আইসক্রিম ওয়ালা না দেওয়ায় নিরাশ হয়ে বাড়ির পথে পা বাড়ায়। হঠাৎ পিছন থেকে “এই খোকা ” বলে কেউ ডাকতেই ভগা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে মোড়ের মাথায় বসা মদন খোঁড়া। ভগা এগিয়ে যেতেই ওর হাতে চারআনা দিয়ে বলে “যা আইসক্রিম কিনে খা”। ভগা ইতস্তত করায় ভিক্ষুক বলল – “এতো ভাবতে হবেনা। আইসক্রিমওয়ালা যে চলে গেল”। ভগা ভিক্ষুকের হাত থেকে চার আনা পয়সা নিয়ে ছুটল আইসক্রিম কিনতে।
মদন দাস, জন্ম থেকেই নিম্নাঙ্গ পলিও আক্রান্ত। শরু লিকলিকে দুই পায়ে কোন জোর পায় না। গরিব ঘরে জন্ম, পড়াশুনা শিখতে পারেনি। যতদিন বাবা-মা বেঁচে ছিলেন ততদিন শারীরিক কষ্ট ছাড়া খাওয়া দাওয়ার কষ্ট ছিল না। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর বাকি দুই ভাই মদনকে ভাঙা চোরা দরমার ঘরটাকে দিয়ে বাকি অংশ বিক্রয় করে দুরে চলে গেছে, যাতে মদনকে না দেখতে হয়। অগত্যা মদন মোড়ের মাথায় বসে খঞ্জনি বাজিয়ে হরিনাম করে ভিক্ষা করে। ওকে ‘মদন খোঁড়া’ বলে সবাই ডাকে। চার আনা, আট আনা যা পায় তাই দিয়ে ভাতে ভাত ফুটিয়ে দিনের বেলাটা কেটে যায়। রাত্রে অর্ধেক দিন খাওয়া জোটে না। তবুও মুখে হাসি নিয়ে হরিনাম করে, যেন ওর কোন কষ্টই নেই। হয়ত, এটাই শ্রী হরির কৃপা।
মদন হরিনাম করে ভিক্ষা করছে। সেই সময় ভগা এসে হাজির। মদন গান করতে করতে ভগাকে বসতে ঈশারা করে। ভগা না বসে চারআনা পয়সা নিয়ে হাতটা মদনের দিকে এগিয়ে দেয়। মদন গান থামিয়ে অবাক হয়ে বলে, “কি ব্যাপার খোকা ?”
– ভগা – “কালকের চারআনা”।
মদন অবাক হয়ে বলে, “আমি কি তোকে ফেরত দিতে বলেছি !” ভগা মাথা নাড়িয়ে, “না, মা বকেছে”।
মদন একটু হেঁসে বললো, ”না বল্লেই হতো” ভগা বলে “রতন বলে দিয়েছে”। মদন বললো “ওটা রাখ। আজ কিছু খেয়ে নিস”। ভগা বললো “আজ স্কুল ছুটি, তুমি পয়সা নাও”। মদন আর জোর করল না। সে বুঝল গঙ্গা জলে গঙ্গা পূজো করে লাভ নেই। তারও তো দানের পয়সা। মদন ভগার হাত থেকে চারআনা নিয়ে ওকে বসতে বললো। তারপড় জিজ্ঞেস করলো, “খোকা তোর নাম কি”? ভগা বলল, “ভগবান বোস”। মদন বেশ আনন্দিত হয়ে বলল, “বা ! বা ! স্বয়ং শ্রীহরি আমার কাছে এসেছেন। হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ”। ভগা অবাক হয়ে গেল। মা ছাড়া কেউ কখনও তাকে কাছে ডেকে নামের প্রশংসা করে কথা বলেনি। ভগাও আপ্লুত হয়ে গেল। ভাবল, এতো দিনে বুঝি মনের মত একজন মানুষ পেল।
বিকেলে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে ভগার লম্ফ -ঝম্ফ নেই। খাওয়ার জন্য চ্যঁচামেচিও করছেনা। বই-এর ব্যাগটা তাকে রেখে চৌকির এক কোনে গিয়ে চুপ করে বসে আছে। মায়ের মনযে, উনি দেখে একটু অস্বাভাবিক লাগায় কি হয়েছে জিঞ্জাসা করেন। ভগা কিছুই বলতে চায়না। কিছু হয়নি বলে চুপ করে বসে থাকে। মা এর অনেক প্রশ্ন বানে শুধু বলে অশোক মাষ্টার মেরেছে। কেন মেরেছে প্রশ্ন করায় অনেক জোড়া জুরি করে জানতে পারল খাতায় চার এর জায়গাতে পাঁচ লিখেছিল তাই। মা জামা খুলতেই দেখেন ফরসা গায়ে লাল লাল বেতের বাড়ির দাগ পড়ে গেছে। উনি একটু রাগান্বিত ভাবে বললেন, “শুধু চার এর জায়গায় পাঁচ লেখার জন্য এই ভাবে মারলেন।” অনিল বাবুর সন্দেহ হল। উনি বিজয়কে বললো রতনকে ডেকে আনতে, তাহলেই সব জানা যাবে। অতঃপর রতন আসলে জানা গেল, স্কুলে ইংরাজি মাষ্টার অশোকবাবু কুমিরের রচনা লিখতে দিয়েছিলেন। সবাই লিখছে। ভগার পাশে বসা অরিন্দমও লিখছে। হঠাৎ করে অরিন্দমের হাত থেকে কলমটা বেঞ্চের নিচে পড়ে যায়। অরিন্দম বেঞ্চের নিচে কলম কুড়াতে গেলে ভগা সেই ফাকে অরিন্দমের খাতায় Crocodile has four leges and one tail এর four কেটে five করে দেয়। উদ্দেশ্য ছিল অশোক মাষ্টারের প্রিয় ছাত্র অরিন্দমকে একটু বকুনি খাওয়ানো। কিন্তু তার পাশের বেঞ্চে বসা বিলে সেটা দেখে ফেলে। এক সময় খাতা জমা পড়ল। স্বভাব সিদ্ধ ভাবে অশোক মাষ্টার অরিন্দমের প্রশংসা করতে করতে খাতার মধ্য থেকে অরিন্দমের খাতাটি খুঁজে বার করলেন। কারন ওর লেখাই অন্য সকলের কাছে উদাহরণ হয়। অশোক বাবু পড়তে গিয়ে যেই দেখলেন কুমিরের চারটি পায়ের জায়গাতে পাঁচ লেখা হয়েছে। ভিষণ রেগে গিয়ে উনি অরিন্দমকে বেঞ্চের উপর দাড়াতে বললেন। কারন ভাল ছেলেরা ভুল করলে শাস্তি বেশি পেতে হয়, যাতে তারা ভুলেও যেন ভুল না করে। ভগার বুকটা জুড়িয়ে গেল। বহু দিনের স্বাধ ছিল অরিন্দমকে একটু বকা খাওয়ানো। এদিকে অরিন্দম হাউ মাউ করে কাঁদতে কাঁদতে জানায় যে সে চারটি পা-ই লিখেছে। ও যে জানে কুমিরের চারটি পা। খামোখা পাঁচটি লিখতে যাবে কেন? এদিকে বিলে প্রথমে ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি। ব্যাপারটা যখন বুঝল, সটান উঠে দাড়িয়ে বলে দেয়। অরিন্দম যখন বেঞ্চের নিচে কলম তুলতে গিয়েছিল, ঠিক তখন ওর খাতায় ভগা কিছু একটা লিখেছিল। ব্যাস ঘটনাটা অশোক মাষ্টারের কাছে জলের মত পরিষ্কার হয়ে য়ায়। উনি অরিন্দমকে বসিয়ে ভগাকে ডেকে এনে উত্তম-মধ্যম বেতের বাড়ি দেন।
মা এর মনতো রক্ত জমা দাগ হওয়া শরীরে নারকেল তেল লাগাতে লাগাতে অপত্ত্ব স্নেহ এবং শাসনের মিশেলে বলেন, “ভগা একটু মানুষ ‘হ’। দাদু অনেক আশা করে তোর নাম রেখেছিলেন ‘ভগবান’। আর তুই সেই নামটা ডোবাচ্ছিস। ছোট ভাই দেখতো কত শান্ত, পরাশুনায় ভাল। কই ওদের দুজনের নামে কেউ কখনো তো কোন নালিশ করে না”। আজ আর ভগা মাকে কোন অজুহাত দেখায় না। মার কথাগুলো শোনার পর ওর শরীরের জ্বালাটা যেন আরো বেড়ে গেল। মাকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললো। মা কোলে টেনে তাঁর বুকের মধ্যে নিয়ে পুত্রের যন্ত্রণার কিছুটা ভাগ নেওয়ার চেষ্টা করলেন। অশ্রু স্বজল চোখে বললেন, “ভগা নিন্দেটা আমাদের হচ্ছে কিন্তু শরীরের কষ্টটা শুধু তোরই হচ্ছে। ওর ভাগটে কাউকে নেওয়া য়ায় না।” ভগা বন্ধু -বান্ধব সব ছেড়ে দিয়েছে। ওরা শুধু তার অসময়ের মজা নেয়। একাই স্কুলে যায় একাই বাড়িতে আসে। মনে মনে ভাবে মার কথা শুনে চলবে। এখন তার এক মাত্র বন্ধু মদন কাকা। মদন কাকাই তাকে বোঝে। স্কুলে যাওয়ার পথে মদনের কাছে একটু বসে। মদন হরিনাম করে গান করে আর ভগা সেইসময় খঞ্জনি বাজায় তারপর স্কুলে যায়। এমন ভাবেই দিন কাটছিল।
হঠাৎ একদিন ভগা স্কুলে যাওয়ার পথে মদনের অখড়ায় গিয়ে দেখে মদন নেই। শিশুমন ভাবল মদন কাকার কুড়ে ঘর চাপা পড়ে কিছু হলনা তো? ছুটল জির্ন কুটিরের দিকে গিয়ে দেখল, না ঘর তো ঠিকই আছে। ভগা বাইরে থেকে ডাকল “ও কাকা” ভেতর থেকে করুন স্বরে উত্তর আসে, “আয় বাপ ভেতরে আয়”। ভগা ভেতরে গিয়ে দেখে মদন কাকা বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছে নিম্নাঙ্গের অকেজ অংশের যন্ত্রণা উপর পযর্ন্ত উঠে গেছে। ঘাড় সোজা করে বসতে পারছেনা। হাত ও নাড়তে পাড়ছে না। কাতর স্বরে জলের কুজোটা হাতের কাছে দিতে বললো। ভগা এগিয়ে এনে দিলে কিছুটা জল খেয়ে বললো, “যা বাপ ইস্কুলে যা, দেরি হয়ে গেলে তোকে আবার মাষ্টার মারবে”।
বিকালে স্কুল থেকে ফিরে ভগা খেতে বসে। কিছুটা খেয়ে ভগা উঠে পড়ে। মনে পড়ে যায় মদন কাকার কিছুই খাওয়া হচ্ছেনা। শুধু জল খেয়ে মড়ার মত বেঁচে আছে। সন্ধ্যা বেলা ঠিক সময়ে পড়তে বসে। মন দিয়ে পড়াগুলো করে। মাও ভগার পরিবর্তন দেখে খুশি হন। রাত্রের খাওয়া দাওয়ার পর মাকে জড়িয়ে ধরে বলে “মা ইস্কুলে আমার ভিষন খিদে পায়”। মা হাসতে হাসতে বলেন “কেন স্কুলে যাওয়ার সময় তো তোমার টিফিন খাওয়ার পয়সা দেওয়া হয়”। ভগা বলে, “ধুস ওতে পেট ভরে না”। মা আরো জোরে হেসে ঠাট্টা করে বলেন “কাল থেকে একথালা ভাত নিয়ে যাবি, দেখবি পেট ভরে গেছে”। ভগা অতি আনন্দে এক মউকায় মার কোল থেকে উঠে দাড়িয়ে বলে, “সত্যি দেবে?”
ভগাকে পর দিন সকালে ঘুম থেকে ডেকে তুলতে হয়নি। সময় মত উঠে হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বসে। পড়া হয়ে গেলে চৌকির তলা থেকে পুরোনো টিফিন কেরিয়ারটা বার করে মায়ের কাছে নিয়ে যায়। মা তাতে রুটি সব্জি আর একটু গুড় ভরে দেন। ভগা স্কুল টাইমের একটু আগেই বেরিয়ে পড়ে।
ক্লাস টিচার অশোক বাবু ক্লাসে ঢোকার পর ভগা ছুটতে ছুটতে এসে ক্লাসে ঢোকে। প্রথম দিন অশোক বাবু শতর্ক করে দেন, এমন যাতে না হয়। কিন্তু এতে কোন কাজ হয়না। পরদিনও ভগা দশ মিনিটের বেশি দেরি করে ক্লাসে ঢোকে। অশোক বাবু রেগে গিয়ে ভগার দুই হাতে তিন তিন ছয় বার জোরে জোরে বেত্রাঘাত করেন। ভগা চুপচাপ, কোন অজুহাত না দেখিয়ে বেত্রাঘাত হজম করে বেঞ্চে গিয়ে বসে। এই ভাবে চার পাঁচ দিন চলার পর অশোক বাবুর সন্দেহ হয়। উনি ভাবেন চুপচাপ রোজ রোজ বেতের বাড়ি হজম করে ক্লাসে ঢোকে, দুষ্টুমি করে না। অন্য ছেলেরা হাসাহাসি করলে প্রতিবাদ করেনা। ওনার কাছে ব্যাপারটা ভাল লাগছে না। স্কুল চলাকালিন উনি পরেরদিন ভগাদের বাড়িতে চলে এলেন। ইদানিং ভগার আচরনগুলো অনিলবাবুকে বললেন। ভগার মা শুনে অবাক। ভগা রোজ স্কুল টাইমের কিছুটা আগেই বেরিয়ে যায়। আরও অবাক হয়ে বললেন, “স্কুলে যে মার খায় তাও আমরা জানতে পারিনি।” অশোক বাবু বললেন, “আমি খোজ নিচ্ছি। তবে আপনারাও নজর রাখুন, বাড়ি থেকে বেড়িয়ে স্কুলে পৌছাতে কেন এতো সময় লাগে !”
সময় মত স্নান খাওয়া সেরে টিফিন গুছিয়ে নিয়ে ভগা রোজকার মত স্কলের উদ্দেশ্যে রওনা হল। পিছন ভগার বাবা-মাও ওকে অনুসরণ করবেন বলে বাড়ি থেকে বার হলেন। পথে দেখা অশোক বাবুর সাথে। উনি ব্যাপারটা জানার জন্য ভগাদের বাড়ির কাছাকাছি অপেক্ষা করছিলেন। তিনজনে মিলে ভগার আচরনের আলোচনা করতে করতে ভগাকে অনুসরণ করে চলেন। ভগা বাড়ি থেকে বেরিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে মদন খোঁড়ার কুটিরে গিয়ে ঢুকল। এদিকে অশোকবাবু, অনিলবাবু আর ভগার মা কুটিরের কাছে এসে অতি সন্তরপনে দরমার ফাঁক দিয়ে দেখতে লাগল ভগা ওখানে কি করছে ! মদন খোঁড়া আগের থেকে অনেক রোগা হয়ে গেছে। সারাদিন ওই একবার চারটে রুটি খায়। ভগা কুজো থেকে এক গ্লাস জল ভরে মদনের পাশে বসে। তারপর টিফিন কৌটো খুলে রুটি ছিড়ে সব্জি মাখিয়ে মদনের গালে তুলে দেয়। মদন অশ্রুস্বজল চোখে বলে, “আগের জন্মে তুই আমার বাপ ছিলি।” ভগা হেসেই খুন। হাসতে হাসতে বলে “তাই হয় নাকি। তোমার বাবা তো আমার থেকে কত বড় তুমিও তো আমার থেকে বড়”। মদনের চোখের কোন দিয়ে নোনা জল গড়িয়ে মুখ পযর্ন্ত চলে আসছে। ভাঙা গলায় বলে – “জানিনা, মনে হয় একটু পুন্যি করেছিলাম, না হলে স্বয়ং শ্রীহরি তোর রূপ ধরে আমার কাছে আসেন !” ভগা বিরক্ত হয়ে বলে “খাও তো। আমার আবার দেরি হয়ে যাবে। অশোক মাষ্টারের বেতের বাড়ি তো খাওনি, খেলে বুঝতে আমার হাতে এখনো দাগ আছে।” হাতটা মদনকে দেখায়। মদন একই ভাবে বলে চলে “তুই আসিস না।” ভগা শাসনের সুরে বলে ওঠে, “আমি না এলে তোমার কি হবে ?” মদন একরাশ হতাশা নিয়ে বলে, “কি আবার হবে ! বেঁচে আর আছি কই বল ? নাহয় না খেয়ে শুকিয়ে মরে যাব। আমার আত্মা যাবে শ্রীহরির চরনে আর শরীরটা পড়ে থাকবে ঘরে। তারপর যখন পচন ধরবে, পুলিশ এসে শরীরটা নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে দেবে।”
ভগার চোখ জলে ছলছল করে উঠল। নরম সুরে আসতে আসতে বললো “আমার বন্ধুর কি হবে ?” মদন বুঝতে পারে ভগা কচি মনে আঘাত পেয়েছে। হলকা করার জন্য বলে “যা, ভগা স্কুলে যা। তোর দেরি হয়ে যাচ্ছে।” এই সব কথোপকথন এর মধ্যে মদনের খাওয়া হয়ে যায়। ভগা টিফিন কৌটো গুছিয়ে রেখে মদনকে বলে, “সাবধানে থাকবে আমি ইসকুল ছুটির পর আসব”।
এগারোটা বেজে দশ মিনিট হয়ে গেছে। ভগা স্কুলের দিকে দৌড়ায়। কুটিরের পেছন থেকে সমস্ত ঘটনা নিরিক্ষন করে তিনজনে রাস্তায় এসে দাড়াল। অশোক মাষ্টার বাঁ -হাত দিয়ে চশমাটা খুলে, ডান হাতের রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলেন –
“I am proud of my boy. You are not Bhagaban Bose. You are only Bhagaban.”
–~০০০XX০০০~–