“কোরক“
✍ শ্যামাপ্রসাদ সরকার
*********************
‘শিশুনিকেতন’ চালাতে যে মোটা রকম একটা খরচ আছে সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। একটা সরকারী গ্রান্টের জন্য আবেদন করা হলেও কবে যে সে টাকা আদৌ আসবে তা বলা কঠিন। বন্দনা মিত্র মানুষটি একটু অন্যরকম, ঠিক আর পাঁচজনের মত অ্যাভারেজ চিন্তাধারার নন বলেই সব প্রতিকূলতা বাঁচিয়ে এই শিশুনিকেতন’টিকে রক্ষা করে আসছিলেন। স্বামী উইং কমান্ডার সুকোমল মিত্র ছিলেন এয়ারফোর্সের সম্ভাবনাময় পাইলট। সুন্দর,ঝকঝকে,সুপুরুষ আর উদারমনস্ক। উত্তর কোলকাতার যৌথপরিবারে বড় হওয়া বন্দনা বিয়ের পর দিল্লীতে গিয়ে সংসার পাতেন সেই সত্তরের দশকের গোড়ায়। সারা কলকাতাটা তখন যেন জ্বলছে। হীরের টুকরো ছেলেগুলো শ্রেণীহীন সমাজের স্বপ্নে মশগুল। যৌবনের সারিবদ্ধ মৃতদেহের স্তুপ তখন ক্রমশ মিশে যাচ্ছে বন্দুকের নল উৎসারিত বারুদের ধোঁয়ায়। দমদম, কাশীপুর, টালা, মতিঝিল তখন দিনদুপুরেও লোকে যেতে দু’বার ভাবত। ফরোয়ার্ড ব্লকের হেমন্ত বসুর মত পিতৃপ্রতীম নেতাও দিনদুপুরে প্রকাশ্যে হঠাৎ খুন হয়ে গেলেন।
সেই সময়ে দিল্লীর লোদী কমপ্লেক্সের উচ্চবিত্ত ফ্ল্যাটে স্বপ্নের উড়ানটা বন্দনার অবশ্য ভালোই শুরু হয়েছিল।
কিন্তু সে সুখ বেশীদিন স্থায়ী হয়নি। একাত্তরের যুদ্ধে গিয়ে সুকোমল আর ফেরেননি। তেরঙায় মোড়া সুকোমলের ট্রাঙ্ক আর কিঞ্চিৎ ঝলসে যাওয়া টুপিটা শুধু ফেরৎ পেয়েছিলেন। শক্ত হয়ে সেসব বুকে নিয়েই ২৬শে জানুয়ারী মরণোত্তর পরমবীর চক্রটিও একাই আনতে গেছিলেন। শত উপরোধেও বাপের বাড়ীতে আর তিনি ফেরেননি। ফ্যামিলি পেনশন আর কোল ইন্ডিয়ার কম্প্যাসনেট গ্রাউন্ডে পাওয়া ক্লার্কের চাকরিতে তিরিশ বছর ধরে তিনি একাই জীবনটিকে নিয়ে এগোতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়ে ছিলেন। বছরে দু একবার কলকাতা আসতেন ছুটিছাটায় তাও যতদিন বাবা মা ছিলেন ততোদিন। রিটায়ার করার পর সোজা একেবারে ‘শিশুনিকেতন’এই এসে ওঠেন।
সুখচরে বন্দনার বাবার বিঘে পাঁচেক জমি ছিল। আটের দশকের মাঝামাঝি সম্পত্তি ভাগাভাগি হলে ওই জমিটুকু নিজের জন্য ভাই দের কাছ থেকে চেয়ে নেন। পরিবর্তে বসতবাড়ীর দাবিটুকু ছেড়ে দেন সানন্দে। সেই থেকে সুখচরে একটু একটু করে ‘শিশু নিকেতন’ কে গড়ে তুলেছেন। এখন রিটায়ার করার পর তো আর কোনই পিছুটান নেই।
‘শিশু নিকেতন’ শুধু মাতৃপরিত্যক্ত অনাথ শিশুদের আশ্রমই শুধু নয় সঙ্গে কো- অপারেটিভ করে দুঃস্থ মেয়েদের লোন দিয়ে বৃত্তিমূলক কাজ শিখিয়ে নিজের পা’য় দাঁড়াতেও সাহায্য করে। একটি বা দুটি শিশু নয়, আজ যেন অজস্র শিশুর মধ্যে মাতৃত্বের আনন্দটা খুঁজে পান। এই পুরো ব্যাপারটায় অবশ্য আর একজনের সাহায্য ছাড়া সম্ভবই হত না; সে হল অপরেশ ! অপরেশ মিত্র, সুকোমলের পরের ভাই। বন্দনা আর অপরেশ একসাথে ইউনিভার্সিটিতে এম এ ক্লাসে পড়তেন। সে সময়ে হাল্কা মুগ্ধতার দৃষ্টিটুকু ছাড়া আর কিছুই কখনো বিনিময় হয়নি সেভাবে। বিয়ের দিনই হঠাৎ আবিষ্কার করলেন যে সেই তার একমাত্র দেওর। বন্দনা কিন্তু দেওর আর বৌদির নির্মল সম্পর্কটাকে অহেতুক পূর্বপরিচিতির চাপে কখনো নষ্ট হতে দেননি। সুকোমলের মৃত্যুর পরে ওবাড়ির বোধহয় একমাত্র অপরেশই রিটায়ারমেন্ট অবধি আজও যোগাযোগ রেখেছে। অপরেশ বিয়ে করেনি। অতিবাম রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিল যুগের হাওয়ায় সেই সময়। পরে অবশ্য মোহভঙ্গ হয়ে সুন্দরবনের দিকে একটা সরকারী ইস্কুলে চাকরি নিয়ে সেখানেই সারাটা জীবন থেকে যায়। বছরে অন্ততঃ একবার দিল্লী এলে দেখা করে যেত সবসময়। কাজের ছুতো নিয়ে দিল্লী এলেও বন্দনা জানতেন যে তার জন্যই ছুতোটুকু কষ্ট করে সে তৈরী করে। অমলিন বন্ধুত্বটুকুর সীমা লঙ্ঘন করেনি বলেই জীবন সায়াহ্নে এসে অপরেশকে ‘শিশুনিকেতনে’র দায়িত্বে যোগ করতে সংশয় হয়নি বন্দনার।
গতসপ্তাহে গুজরাত থেকে একটি দম্পতি আবেদন করেছে এখান থেকে একটি বছর তিনেকের শিশুকে দত্তক নেবার ইচ্ছা প্রকাশ করে। সবে একবছর হল সরকারি নিয়ম মেনে শিশু দত্তক দিচ্ছে ‘শিশু নিকেতন’। কোনও টাকাপয়সা দাবী করা হয়না শুধু দত্তক নেওয়া শিশুটির সঙ্গে আশ্রমের আরো একটি যে কোন শিশুর একবছরের ভরণপোষণ ও পড়াশোনার খরচটি অনুদান হিসেবে নেওয়া হয়।সরকারী গ্রান্ট এসে গেলে বন্দনা সেটিও বন্ধ করে দেবেন বলেই স্থির করেছেন। দত্তকের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সব তৈরী হয়ে গেছে। সামনের সোমবার দম্পতিটির আসার কথা। বন্দনা বলে দিয়েছেন এইবারের সব কিছু অপরেশের হাত দিয়েই হবে। উনি ওদিনটায় ছুটি নেবেন ব্যক্তিগত কারণের জন্য। একথা শুনে অপরেশ ভাবেন সোমবার সতের তারিখ; দাদার মৃত্যুদিন বলেই কি বন্দনা নিজেকে আত্মমগ্ন নিভৃতিতে রেখে স্মৃতিমন্থন করতে বসবেন? যুক্তি দিয়ে এসবের ব্যাখ্যা হয়না। তবুও অপরেশের না বলার উপায় নেই।
বেলা এগারোটার মধ্যে কাগজপত্রের কাজ সব মিটে গেলে ওরা শিশুটিকে নিয়ে চলে গেল। সাড়ে তিনবছরের ছোট্ট ‘দয়িতা’র নাম দিয়েছিলেন বন্দনাই। ওরা চলে যাবার পর দুপুরের দিকে দোতলা থেকে নেমে একসময় অফিসঘরে আসলেন বন্দনা।
খুব নির্ভার লাগছে নিজেকে এবার। তিন বছর আগেকার একটি স্মৃতি মনে পড়ে গেল। এক ধনী গুজরাতি পরিবারের মেয়ে অস্মিতা তার প্রেমিকের সাথে সহবাসে প্রেগনেন্ট হয়ে পড়ে। প্রেমিকটি স্বাভাবিক নিয়মেই এ্যাবরশনের পক্ষেই জোর করে। মেয়েটির অটল জেদের সামনে শেষে রণে ভঙ্গ দিয়ে ব্রেকা-আপের পথই বেছে নেয়। কিন্তু মেয়েটি অত্যন্ত সাহসের সাথে, তীব্র জেদের সঙ্গে সেই বাচ্চাটিকে জন্ম দেয় একটা ছোট অখ্যাত নার্সিংহোমে, বাড়ির লোকের একরকম অমতেই। মেয়েটি তার বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করা বউটির মাধ্যমে তাদের ‘শিশুনিকেতন’এর খোঁজ পায় আর তার পাঁচদিনের সদ্যোজাত কন্যাসন্তানটিকে নিয়ে এক সন্ধ্যায় এসে হাজির হয় আর বন্দনার জিম্মায় রেখে দেওয়ার একান্ত অনুরোধ জানায়। বন্দনার নিজের অনিচ্ছাসত্ত্বেও মেয়েটিকে সেদিন না বলে ফেরাতে পারেননি। তার নিষ্পাপ দৃষ্টিতে ছিল দৃঢ়তার অশনি সংকেত। সেই থেকে ছোট্ট ‘দয়িতা’ আর পাঁচটি বাচ্চার সাথে ‘শিশু নিকেতনে’ বড় হতে থাকে সময়ের সাথে সাথে।
তারপর এই সাড়ে তিনবছরে সেই মেয়ে নিজের কেরিয়ার গড়ে সমাজে শুধু নিজেকে প্রতিষ্ঠিতই করেছে তাই নয়, গুজরাতের নামী রত্নব্যবসায়ী পরিবার মানসুখানি বাড়ির বড়লোক গৃহবধূ হয়েও নিঃসন্তান থেকে গেছে ইচ্ছা করে।
বন্দনাকে সে নিজে মাসখানেক আগে তার জীবনের সবকথা চিঠিতে লিখে জানায় আর বলে সে তার নিজের কুমারী জীবনের সন্তানটিকেই দত্তক নিতে চায়, বন্দনা যেন তার যথাযথ ব্যবস্থা করেন গোপনীয়তা বজায় রেখেই। তার জীবনের প্রথম কোরকটিকে আশ্রয় দিতে একদিন সে সত্যিই অপারগ ছিল, কিন্তু আজ সে সমাজে প্রতিষ্ঠিতা। সেইজন্য সেই আত্মজাটিকেই প্রথমে বুকে তুলে নেবার জন্য সে ইচ্ছে করেই এখনো দ্বিতীয়বার মা হয়নি। যৌবনের প্রথম অর্ঘ্যটিকে তার যথার্থ স্বীকৃতি দিয়েই সে তারপর আবার নতুন করে দ্বিতীয়বার মাতৃত্বের স্বাদ পেতে ইচ্ছুক। বন্দনা সে চিঠি পড়ে অবাক হয়ে খানিক্ষণ চুপ করে বসে থাকেন। কি যে ঠিক করণীয়, তা ভাবতে ভাবতে ভিতরে ভিতরে অধৈর্য্য লাগে যেন। অবশেষে মা’এর মনটাই জিতে যায় দুজন অসমবয়সী নারীর।
আজ সেই বৃত্তটি সম্পূর্ণ হল অবশেষে।সুকোমলের মৃত্যুদিনটি এতদিন শুধুই এক প্রহর শেষের স্মৃতি হয়েই আচ্ছন্ন ছিল, আজ থেকে তা যেন সূচনার আলোয় ঐশ্বর্যবানও হয়ে উঠল নতুন করেই।
–~০০০XX০০০~–
কোরক গল্পটা ভ্ল লাগলো, তবে বাস্তবে এরূপ ঘটনা স্বপ্নাতিত।