“এক রহস্যময়ীর গল্প”
মূল রচনা : An Enigmatic Nature
লেখক : আন্তন চেকভ
অনুবাদ : নিলয় বরণ সোম
[লেখক পরিচিতি : আন্তন প্যাভেলরিচ চেকভ একজন রাশিয়ান নাট্যকার ও গদ্যকার (১৮৬০-১৯০৪).I পেশায় চিকিৎসক এই লেখককে পৃথিবীর সর্বকালের শ্ৰেষ্ঠ গদ্যকারদের একজন হিসেবে গণ্য করা হয়।তার সৃষ্ট নাটকগুলোর মধ্যে সী- গাল সমধিক প্রসিদ্ধ। সৃজনশীল সাহিত্যে ‘ চেকভের বন্দুক ‘ বলে একটিধারণার উনি উদ্গাতা , এই ধারণাটিতে বলে যে যে কোন সৃষ্টি কর্মে প্রতিটি উপাদানই জরুরী , জরুরী নয় এমন উপাদানকে সরিয়ে দেওয়া লেখকের কর্তব্য।
গল্পটি লেখকের “The Horse-Stealers and Other Stories” অন্তর্ভুক্ত। প্রজেক্ট গুটেনবার্গের অন্তর্গত গল্পটির রুশ ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন Constance Garnett কন্সট্যান্স গার্নেট।, বর্তমান অনুবাদটি গার্নেট কৃত অনুবাদের অনুবাদ।
এই গল্পটিতে রাস্কিনলোভ ও তার চুম্বনের যে উল্লেখ আছে, সেটি র করিম এন্ড পানিশমেন্ট উপন্যাসে বিধৃত।
কপিরাইট বন্ধন মুক্ত লেখকের লেখাগুলো অন্তর্জালে প্রজেক্ট গুটেনবার্গ খোঁজ করলে পাওয়া যায়। তা ছাড়া , আগে রাশিয়ার মীর প্রকাশনায় লেখকের ইংরেজি অনুবাদ গুলি পাওয়া যেত। উৎসাহী পাঠক বইয়ের দোকানে অন্য প্রকাশনার ইংরেজি অনুবাদও খুঁজে দেখতে পারেন।]
ট্রেনের ফার্স্ট ক্লাস কামরার নরম গদীতে এক ভদ্রমহিলা হেলান দিয়ে বসে আছেন।একটা খুব দামি , ঝালর বসানো পাখা নাড়িয়ে উনি হাওয়া খাচ্ছেন , মহার্ঘ একটা সানগ্লাস ওঁর নাকের ডগার নীচে নামান , সুন্দর ব্রোচটি ঠিক সমদ্রে ভাসা নাওয়ের মত তার কুসুম কোমল বুকের উপর দুলছে।ভদ্রমহিলাকে খুব উত্তেজিত দেখাচ্ছিল।
ভদ্রমহিলার ঠিক উল্টোদিকের সীটে রাজ্য প্রশাসনের একজন কর্তাব্যক্তি বসে আছেন। যুবকটির আরেকটি পরিচয় উঠতি লেখক হিসেবে। সবথেকে নামকরা সাময়িকপত্রে ওঁর ‘উপন্যাসিকা ‘ প্রায়ই প্রকাশিত হয়। কোন শিল্পরসিক যেমন গ্যালারিতে টাঙানো ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে ভদ্রলোক , ভদ্রমহিলার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তেমনই তাকিয়ে আছেন I তার দৃষ্টিতে ভদ্রমহিলা এক অপরূপা রহস্যময়ী , তার চেহারার প্রতিটি ভঙ্গি উনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন – উনি ওকে বুঝতে পারছেন , ওর মন খোলা বইয়ের পাতার মত যেন তাঁর চোখের সামনে ।
ভদ্রলোক , ভদ্রমহিলার হাতের ব্রেসলেটটির কাছে একটি চুম্বন এঁকে দিয়ে মুখ খুললেন , ” আপনার আদি থেকে অন্ত আমি বুঝি ম্যাডাম। আপনার লড়াইটা দূর্ধর্ষ , কিন্তু আপনার কোমল মন সমস্ত ঝামেলা থেকে মুক্তি চাইছে -মনের জোর হারাবেন না ম্যাডাম, জয়ী আপনি হবেন ই !
একটু বিমর্ষ মুখে ভদ্রমহিলা বললেন , “স্যার , আপনি তো লেখক, আমাকে নিয়ে লিখুন ! আমার জীবন এত চড়াই উৎরাই পেরোন, এত বিচিত্র ! তবে আমি সুখের মুখ দেখি নি। দস্তয়োভস্কির গল্পে যেমন জীবনযন্ত্রনায় দগ্ধ্ মানুষের বর্ণনা পাওয়া যায়, আমার জীবনটাও তেমনি। স্যার , আমার কাহিনী সারা পৃথিবীর কাছে পৌঁছে দিন। আপনি একজন সত্যিকারের সাইকোলোজিস্ট, একঘন্টাও হয়নি আমরা একসঙ্গে আছি , এর মধ্যেই আপনি আমার মনের কথা পড়ে নিয়েছেন !”
– “বলুন ম্যাডাম , আমি আপনাকে হাতজোড় করে বলছি, আপনার সব কথা খুলে বলুন আমাকে !”
-” মন দিয়ে শুনুন স্যার ! আমার বাবা গরিব কেরানী ছিলেন। বাবার মাথায় বুদ্ধি ছিল , এমনিতে ছিলেন দিলদরিয়া -কিন্তু পরিবেশের একটা প্রভাব তো থাকেই , বুঝলেন না ? বাবাকে আমি দোষ দেই না। মদ খেতেন , জুয়া খেলতেন , ঘুষ -ঘাষ ও নিতেন টু পাইস। মায়ের কথা আর কী বলব – দারিদ্রের মধ্যে রোজ দুবেলা খাবার জন্য লড়াই , কীটের মত বেঁচে থাকার যন্ত্রনা , এ সব আর মনে করবেন না -ওহ !আমার রাস্তা আমাকে নিজেকেই বের করে নিতে হয়েছিল। বুঝতেই পারছেন , বোর্ডিং স্কুলে থেকে পড়াশুনা , উল্টোপাল্টা নভেল গেলা , কাঁচা বয়সের টুকটাক ভুল ,আর জীবনে প্রথম ভালবাসার ছোঁয়া -সব মিলিয়ে ভয়ানক ব্যাপার একটা। কত দ্বিধা দ্বন্দে ভোগা , জীবনের উপর, নিজের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলা ! কী আর বলব, আপনি তো লেখক -আপনি মেয়েদের কথা ভাল বুঝতে পারেন। দুঃখের ব্যাপার এই, আমার ধরনটা হল তীব্র প্রকৃতির। আমি শুধু সুখ খুঁজে বেড়াতাম আর কী সেই সুখ ? আমি চাইতাম আমার আত্মাকে মুক্ত করে দিতে -আর এতেই আমি সুখ খুঁজে পেয়েছি অবশেষে।“
-“খুব, খুব সূক্ষ্ম অনুভূতি আপনার” – ব্রেসলেটের কাছে হাতটিতে আবার একটি চুম্বন এঁকে দিয়ে ভদ্রলোক বললেন ,
” ম্যাডাম আমি ঠিক আপনাকে চুম্বন করছি না , আমি চুম্বন করছি মানুষের দুর্দশাকে। রাসকলনিকোভ আর তার চুম্বনের গল্পটি মনে আছে তো ?”
-“ঠিক, স্যার , বিনয় করে কী হবে , সুনাম , সুখ্যাতি , সাফল্য , সব, সব চাইতাম আমি ! সবসময় চাইতাম সাধারণের উপরে উঠতে , আর পাঁচটা মেয়ের মত ভাগ্য আমার হোক এ আমি চাইতাম না -আর শেষ অব্দি জড়িয়ে গেলাম এক বিশাল বড়োলোক , বুড়ো জেনারেলের সঙ্গে ! স্যার ভেবে দেখুন, এটা আসলে আমার আত্মত্যাগ ! চিন্তা করে দেখুন,আমার কিন্তু উপায় ছিল না আর I আমি পরিবারের ভাগ্যের চাকাটা ঘোরাতে পেরেছি , দেশ বিদেশ ঘুরেছি , অনেক ভাল জিনিসের স্বাদ পেয়েছি , অথচ আমার কি যন্ত্রনাময় জীবন ছিল ! ভেবে দেখুন, ওই বুড়ো যখন আমাকে জড়িয়ে ধরতে, আমার কেমন ঘৃণা হত। তবে একথা স্বীকার করতেই হবে, বয়সকালে ও বীরের মত লড়তI অনেকগুলো মুহূর্ত আমার অসহ্য লাগত, কিন্তু এই ভেবে নিজেকে স্বান্তনা দিতাম যে বুড়ো তো একদিন না একদিন মরবে ,আর সেদিন থেকে আমি নিজের মত করে বাঁচতে পারব– আমার মনের মানুষের কাছে নিজেকে সমর্পন করতে পারব , সত্যি সুখী হব! স্যার, এমন একজন মানুষ কিন্তু আমার আছে !”
সুন্দরী এবার আরো জোরে জোরে হাওয়া খেতে লাগলেন। এরপর কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলতে থাকেন ,
” যাই হোক, সে বুড়ো তো একদিন মারা গেল। আমি খাঁচা ছাড়া মুক্ত পাখি হয়ে গেলাম – বলুন না স্যার ,এবার তো আমার সুখী হওয়ার কথা, তাই না ?সুখ তো এবার আমার দরজায় কড়া নাড়ছে -আমার তো শুধু তাকে ঢুকতে দেওয়া বাকি। স্যার, অনুরোধ করছি, শুনুন ভাল করে ! এবার তো আমার প্রেমিকের কাছে চলে যাওয়া উচিত , তার জীবনসঙ্গী হওয়া উচিত , ওকে সাহায্য করা উচিত , ওর আদর্শ তুলে ধরা উচিত , এ সময়ই সুখী হতে হয় , বিশ্রাম নিতে হয় চক্কর থেকে , কিন্তু স্যার , আমাদের জীবন কীরকম জঘণ্য, কী রকম নিরর্থক ভাবুন !হতভাগিনী , সত্যিকারের হতভাগিনী আমি !আবার আমার চলার পথে বাধা ! আবার বুঝতে পারছি আমার জীবনে সুখের স্পর্শ অনেক দূরের ব্যাপার। আমার যে কি জ্বালা আপনি যদি বুজতে পারতেন !”
-“বলুন ম্যাডাম বলুন -আপনার চলার পথে আবার কী বাধা এল ?”
“আবার এক বুড়ো জেনারেল -বেজায় ধনী !”
হাতপাখাটি সুন্দরীর মুখটাকে আড়াল করে রইল। লেখক মহাশয় মনস্তত্ববিদের মত হাতের মুঠির উপরে কপালটি রাখলেন। ঝিক ঝিক শব্দ করে রেলগাড়ি চলতে লাগলো আর জানালার পর্দার উপর অস্তগামী সূর্যের লাল আভা খেলে বেড়াতে লাগল।
–~০০০XX০০০~–