“অমৃতস্য পুত্রা:”
✍ কাকলি ঘোষ
অখিলবাবু ভারী ভুলো মানুষ। সবকিছুতেই আজকাল বড্ড ভুল হয় তার। ডাল এর সঙ্গে ভাজা খেতে ভুলে যান, মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে নেন এদিকে মাছ যেমনকার তেমন বাটিতে পড়ে থাকে। আগের দিন চুল কেটে এসে পরেরদিন আবার গিয়ে হানা দেন সেলুনে। ধুতি পরেন তো পাঞ্জাবি গায়ে দেন না __ চশমা পরেন তো মানিব্যাগ ভোলেন। সে একেবারে কেলেঙ্কারি কান্ড ! আর বাজার ? সে নিয়ে তো নিত্য অশান্তি। গৃহিনী মৃন্ময়ী বেজায় বেজার এই কারণে। লিস্ট করে ব্যাগ, টাকা গুছিয়ে দিয়ে বাজার পাঠান। পকেটের লিস্ট পকেটেই পড়ে থাকে। দরকারি জিনিসপত্র কিছুই আসেনা। এদিকে নিষেধ করলেও শোনেন না। বাজার তার নিত্যি যাওয়া চাই। তবে ইদানিং সকলেই জেনে হয়েছে অখিল বাবুর সমস্যাটা। তাই এখন বাজারে গিয়ে দাঁড়ালেই সবজিওয়ালা, মাছওয়ালা নিজেরাই বলে ,
” লিস্ট বার করুন মাস্টার মশাই। ”
ফলে ঈপ্সিত জিনিসগুলো এসে যায় ঠিকই কিন্তু শুধু বাজারেই তো শেষ নয়। ভুল, ভুল। অখিলবাবুর সব কিছুতে আজকাল ভুল। এই তো সেদিন ! কি কান্ডটাই না করলেন ! বড় বৌমার ভাইয়ের বিয়ে। বাড়ি শুদ্ধু সব নেমন্তন্ন। এদিকে অখিল বাবু যেতে চান না কোথাও। ভীড় ভাট্টা বরাবরই পছন্দ নয় তার। মৃন্ময়ীরও যাবার ইচ্ছে ছিল না। এই লোককে রেখে যাবেনই বা কি করে ? কিন্তু ছেলের শ্বশুরবাড়ি। কুটুম । কত্তা গিন্নির দুজনের একজনও না গেলে ভালো দেখায় না। অগত্যা যেতে হল। যাবার আগে খাবার দাবার টেবিলে গুছিয়ে রেখে পই পই করে বলে দিয়ে গেলেন যেন সদর দরজা বন্ধ করে খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়েন। তারা এলে ডাকবেন।
গেলেন তো। কিন্তু মনে মনে শান্তি পাচ্ছিলেন না মৃন্ময়ী। কি যেন এক বিজাতীয় অস্বস্তি চিন চিন করছিল ভেতরে ভেতরে। মনে হচ্ছিল একটা কিছু গোলমাল হবে। আর হলও তাই। রাত বারোটায় সদলবলে বাড়ি ফিরে দেখলেন সদর দরজা হাট করে খোলা। নিচে খাবার ঘরে টেবিলে মাথা রেখে অঘোরে ঘুমোচ্ছেন বাড়ির কর্তা আর এদিকে রান্নাঘর, ভাঁড়ার ঘর থেকে রাজ্যের জিনিসপত্র, বাসন কোসন মায় গ্যাস সিলিন্ডার পর্যন্ত উধাও। মাথা চাপড়াতে চাপড়াতে তখন ভাবছেন মৃন্ময়ী ভাগ্যিস ওপরের ঘরগুলোয় ডবল তালা ঝুলিয়ে যাওয়া হয়েছিল ! নইলে সব যেত আজ। সবথেকে রাগ হয়েছিল যখন ডেকে তোলার পর অখিলবাবু প্রশ্ন করলেন তাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে দেওয়া হল কেন ? কি বলবেন ? কী বলা যায় এসব মানুষকে ! বলেনও নি মৃন্ময়ী। শুধু বড় ছেলেকে ডেকে হুকুম করেছিলেন আর ফেলে রাখা যাবে না। এবার ডাক্তার দেখানো অবশ্যই দরকার।
তো গেলেন অখিল বাবু। ডাক্তার দেখলেন। কি একটা গালভরা নামও বললেন রোগটার। যথা রীতি ভুলে গেছেন তিনি। কি যে জ্বালা !
এই যে সকালে বাজার আসার আগে শুনলেন কিসের একটা ছুটি যেন আজ। বড় ছেলে যে কিনা প্রধান মন্ত্রীর চেয়েও ব্যস্ত সেও বাড়ির সবার সঙ্গে বসে চা খাচ্ছে ! কিন্তু ছুটিটা কিসের সেটা কিছুতেই মনে করতে পারছেন ? না। ওষুধ পত্র তো খাচ্ছেন। কাজ যে কি হচ্ছে কতটুকু হচ্ছে কিছুই বোঝেন না। তার চেয়ে ___
কি ব্যাপার ! অত ভীড় কেন ওখানে ? কি হয়েছে ?
বাজারে ঢোকার মুখে থমকে দাঁড়ালেন অখিল বাবু। গোল হয়ে জায়গাটা ঘিরে ধরে দেখছে কি সবাই? কিছু গোলমেলে ? পা বাড়াতে যেতেই পিছন থেকে হাঁক মারে নুরুল,
” মাষ্টারমশাই __ এদিকে আসেন । মাংস কত লিখে দিয়েছেন মাসীমা ? ”
নুরুলের মাংসের দোকান। বরাবর ওর থেকেই নেন অখিল বাবু। জিনিসও ভালো আর নুরুল মানুষ টাও।
” ওখানে কি হয়েছে নুরুল ? “
পকেট থেকে ফর্দ বের করে ওর হাতে দিতে দিতে প্রশ্ন করেন অখিল বাবু।
” ও বাদ দিন না মাষ্টার মশাই। যত নোংরা কান্ড। ”
ভ্রু তুলে তাকান অখিল বাবু। মানে ?
মাংস কাটতে কাটতে একটু ইতস্তত করে নুরুল। তারপর বলেই ফেলে , ” একটা বাচ্চা মাস্টার মশাই। কে ফেলে গেছে কে জানে ? আজ সকালে মতি কাজে যাবার সময় দেখতে পেয়েছে। দুটো কুকুর ঘিরে রেখেছে। ”
” সে কি ! “
” হ্যাঁ ”
” পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছে ? বাচ্চাটা কোথায় ?”
” মতি ই লোকজন ডেকে এনেছে। পুলিশে খবরও দিয়েছে কে একজন। তাদের নাকি আসতে দেরি হবে। এদিকে বাচ্চাটা চেঁচিয়ে একসা করছে। “
” মানে ! কেউ তুলে নিয়ে যায়নি এখনও ?”
” কে ওসব ঝামেলায় জড়াবে মাস্টার মশাই ? কার পাপ কে জানে ? তারপর কোথা থেকে কি হবে __”
” কই ? কোথায় দেখি ?”
নুরুল বাধা দিয়ে ওঠার আগেই ভিড়ের মধ্যে ঢুকে যান অখিল বাবু। কাজে না লাগুক মজা দেখার লোকের অভাব তো এদেশে কোন কালেই নেই। এখানেও সেই অবস্থা। ওইটুকু দুধের শিশু পড়ে আছে একটা ন্যাকড়া জড়ানো অবস্থায় ! আর এই এতগুলো লোক স্রেফ দাঁড়িয়ে মজা দেখছে। হা ঈশ্বর ! এদের কি চোখের চামড়া পর্যন্ত নেই ! আর থাকতে পারেন না অখিল বাবু। নিজেই এগিয়ে যান অপটু হাতে বাচ্চাটাকে তুলে নিতে।
” আরে আরে করেন কি মাস্টার মশাই ! হাত দেবেন না। পুলিশ আসছে। “
” পুলিশে ছুঁলে কিন্তু আঠেরো ঘা। “
” আপনি তো আচ্ছা লোক মশাই ! এই বয়সে ঝামেলায় জড়াতে ইচ্ছেও করে ! পারবেন আপনি সামলাতে ? “
কয়েক মুহুর্তের জন্য থমকে যান অখিল বাবু। মৃন্ময়ীর কঠিন মুখটা চোখের সামনে পলকে ভেসে ওঠে। বাচ্চাটাকে বাড়ি নিয়ে গেলে কী যে ভীষণ ঝড় উঠবে সেটা আন্দাজ করা শক্ত নয়। কিন্তু তাই বলে এ অবস্থায় __
” কই ? কই ? দেখি ? সরো তো বাপু তোমরা __ সরে দাঁড়াও। ”
হই হই করতে করতে যে সামনে এসে দাঁড়ালো তাকে বিলক্ষণ চেনেন অখিল বাবু। বিজলী। যেমন চেহারার ধার তেমনি মুখের। বাজারে মাছ বিক্রি করে। মন্দ লোকে অবশ্য বলে থাকে শুধু মাছ বিক্রি করাই পেশা নয় ওর। রাতের বেলা আরো অন্য কিছুর বেসাতিও আছে ওর ।
” আপনি সরে আসুন মাস্টার মশাই। ও কি আপনার কাজ ? দিন দিন আমার হাতে দিন। ” দুহাত বাড়িয়ে দেয় বিজলী।
” থানা থেকে খবর পাঠিয়েছে মেজবাবু আসছেন। তোর এত ওস্তাদির কি দরকার ? সব কিছুর ই একটা নিয়ম আছে জানবি “
বাচ্চাটাকে গুছিয়ে কোলে নিচ্ছিল বিজলী। ভিড়ের মধ্যে থেকে উড়ে আসা কথাটা শুনে মুখ তুলে তাকায় একবার। তারপর ঠোঁট বেঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে,
“মেজো বাবু এলে বিজলীর ঘরে পাঠিয়ে দিও গো বাবুরা। বলে দিও রাস্তার ডাস্টবিনে পড়ে গলা শুকোচ্ছিল তো বাচ্চাটা ___ তাই বিজলী নিয়ে গেছে। যত সব। ছাড়ো ছাড়ো। রাস্তা ছাড়ো দেখি ! দুধের বাছার আমার গলা শুকিয়ে কাঠ ! আর যত ভদ্দ লোকের দল দাঁড়িয়ে মজা মারছে আর নিয়ম দেখাচ্ছে __ ! হা ! “
ভীড় করে দাঁড়িয়ে থাকা জনতাকে স্তব্ধ করে দিয়ে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে দুলকি চালে চলে যায় বিজলী। ওর চলে যাবার পথের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বিদ্যুচ্চমকের মত মনে পড়ে যায় অখিল বাবুর। মনে পড়ে যায় আজ কিসের ছুটি। আজই তো সেই দিন ! আজকের দিনেই তো সেই রাজার রাজা পৃথিবীতে এসেছিলেন ! আজ পঁচিশে ডিসেম্বর। আজ বড়দিন।
–~০০০XX০০০~–
কাকলি ঘোষের লেখা অমৃতস্য পুত্রাঃ …
ঘটনার কথা যদি বলি, প্রথমেই মনে আসে–এমন কেনো সত্যি হয়না আহা– কিন্তু সত্যি হয়। অসংখ্য উদাহরণ আছে তার।
সবাই অমানুষ হলে পৃথিবীর গতি স্তব্ধ হয়ে যেতো। সঙ্গে ভুলভুলাইয়া বেশ মানানসই। সহজ ভাষায় সুখপাঠ্য।
।।শৃণ্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাঃ।।
একদম ঠিক 💐💐
বেশ মনোগ্রাহী গল্প । আপাত নিরীহ চালচুলোহীন মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্বের উদাহরণ দারুন লাগল । আজকের দিনে ভীষণ প্রাসঙ্গিক ।
অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে মন ছুঁয়ে যাওয়া কাহিনী
এইরকম ভালো লেখা সবুজ স্বপ্নই ছাপে।
লেখিকাকে সাধুবাদ জানাই