“ফিরে দেখা (৩য় পর্ব)”
✍ কাকলি ঘোষ
নাটকের কথা বলার আগে আর একজনের কথা না উল্লেখ করলে অন্যায় হবে। সে হল আমার মাসতুতো বোন মিঠু। হ্যাঁ প্রায় চোরে চোরে মাসতুতো বোন বলা যেতেই পারে। আমার দুপুর বেলার যাবতীয় দুষ্কর্মের সংগী ছিল মিঠু। কুল পাড়া থেকে শুরু করে দিদিমার আচার সাবাড় করে পর্যন্ত সর্ব প্রকার মহৎ কাজের সাথী ছিল মিঠু। যারা আমার ‘রইল নিমন্ত্রণ’ বইটি সংগ্রহ করেছেন তারা অবশ্যই ‘নিরুদ্দেশ’ গল্প টি পড়েছেন। ওই গল্পের অতসী চরিত্রটি মিঠুর ছাঁচে গড়া। যাকে আমি কোনদিন ভুলি নি। ভোলা সম্ভব ও না।
যাক সে কথা।
“চাকুরির বিড়ম্বনা” আমাদের প্রথম সামাজিক পূর্ণাঙ্গ নাটক। কিন্তু তার আগেও বেশ কিছু নাটক অভিনীত হয়েছে। সেগুলো বেশীর ভাগই রূপকথার গল্প থেকে ধার করা। সবগুলোর নাম আজ আর মনে নেই। কিন্তু একটি নাটকের সঙ্গে এমন কিছু হাস্যকর স্মৃতি জড়িয়ে আছে যা বলার লোভ সামলাতে পারছি না। এই বিশেষ নাটকটির নাম ছিলো ‘ অচিনপুরের রাজকন্যা’ ।লেখিকার অভিনয়ের থেকে লেখা এবং পরিচালনায় আগ্রহ বেশী ছিলো। এছাড়াও নাট্যকার নিজে মঞ্চে থাকলে বাকী দিকগুলো বিশেষ করে প্রম্পটিং এবং নির্দেশনায় সমস্যা দেখা দেয়। তবু ও পাঁচজনের সনির্বন্ধ অনুরোধে সে নাটকে রাজার ভুমিকায় ছিলো স্বয়ং নাট্যকার।গল্পটা সবিশেষ স্মরণে নেই তবে এইটুকুই মনে আছে যে রাজার কাছে ভিন্ন দেশের দুই দূত এসে সেখানকার রাজকন্যার রূপ গুণের কথা সবিস্তারে বলছে। এবং তারপর সেই রাজকন্যার উদ্দ্যেশ্যে রাজার অভিযান। যেহেতু নাট্যকার নিজে ও মঞ্চে —তাই প্রম্পটিং এর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল অন্য একজনকে। এখানে ও একটা ছোট্ট কাহিনী আছে। যাকে প্রম্পটিং এর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সে ছিল নাটক সম্পর্কে একেবারে অজ্ঞ। সুতরাং এ ব্যাপারে নাট্যকারের ঘোরতর অমত ছিলো। কিন্তু প্রস্তাবটা এলো সম্পূর্ণ অন্য দিক থেকে। আমার বড়মামীমা ছিলেন আমাদের নাটকের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। তার সহযোগিতা ছা়ড়া আমাদের পক্ষে এতসব করা অসম্ভবই ছিলো। তো আমাদের এই প্রম্পটার বেগতিক দেখে কখন যে তার শরণাপন্ন হয়েছে জানতে পারিনি। বড়মামীমা যখন ডেকে ওকেই প্রম্পটিং এর দায়িত্ব দিতে বললেন তখন অনিচ্ছাতেও রাজী হতে হোল। মনে কিন্তু খুঁতখুঁতুনি থেকেই গেল । প্রম্পটিং নাটকের যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। তা এমন লোকের হাতে পড়া আমার মোটেই পছন্দ হয় নি।
প্রম্পটিং এর মতোই মেকাপ ও নাটকের আর এক উল্লেখযোগ্য দিক। আর সেটার প্রতি আমরা একটু বিশেষই মনোযোগী ছিলাম। তাই আমাদের হাত থেকে বাঁচতে মামীমা এবং মাসীরা নিজেদের সাজগোজের জিনিস আলমারীতে তুলে রাখতেই পছন্দ করতেন।থাকার মধ্যে পড়ে থাকত শুধু এক বারোয়ারী পাওডারের কৌটো। আর সেটার যথাসম্ভব সদব্যবহার যে আমরা করতাম তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তার সঙ্গে আর একটা জিনিসও যোগ করতাম যা শুনলে এখনকার ছেলেমেয়েরা শিউরে উঠবে। সেটা হল দোল খেলার পর বেঁচে থাকা বাড়তি আবীর ,রঙ ইত্যাদি।
মেকআপ করানো তে ভাইয়ের উৎসাহ যতটাই বেশী ছিলো সেন্স ছিলো ততটাই কম। মানে ছিলো না বললেই চলে। কার কোথায় কেমন সাজ হবে এসব ওর মাথায় ঢুকত না। হাতে রঙ পেলেই হল। এ নিয়ে প্রতিবার একটা না একটা ঝামেলা লেগেই থাকত। ফলে সতর্ক থাকতে হোত আমাকেই। সেবারও সাজঘরে ( যেটা ছিল আসলে দাদু এবং দিদিমার শয়নকক্ষ) ঢুকে দেখি সে এক হুলস্হূল কান্ড। যেদিকে তাকাই সব এক! রাজকন্যা থেকে শুরু করে দূত পর্যন্ত সকলেরই মুখের রঙ গোলাপী। মানে কে কোনটা বোঝা দায়। বুঝলাম বেঁচে যাওয়া আবীর যথাস্হানেই যথেচ্ছ ব্যবহৃত হয়েছে। ভাবুন একবার কান্ডখানা!! মেকাপম্যানের এহেন নৈপুণ্যের পরিচয় পেয়ে যখন কী করব ভেবে উঠতে পারছি না–তখনই দলের একজন সদস্যের আর্তচীৎকার! ছুটে গিয়ে দেখি বেচারীর লম্বা চুলের গোছা ভাইএর হাতে!
” কী করছিস রে ? ছাড় ছাড়”
” দাঁড়া চুলের মেকাপটা করে দিই”—- ভাইয়ের গোলাপী মুখে সাদা দাঁতের সে কী অনাবিল হাসি!
কোনরকমে তাকে উদ্ধার করে সে যাত্রা রক্ষা পাই।
বলতে ভুলে গেছি আমাদের নাটকের আগে একটা উদ্বোধনী সঙ্গীত অবশ্যই হোত। আর তার বাঁধা ধরা শিল্পী ছিলো শম্পা। এ ব্যাপারে কোন বিকল্প ছিলো না। কারণ অবশ্যই ছিল। প্রথমত শম্পার গলা ছিল অ—মাইক। অমন চাঁছাছোলা গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে লোক জড়ো করার শিল্পী আমরা আর পাই নি। দ্বিতীয়ত শম্পার গুমোরের বালাই ছিলো না। গান শোনাতে গেলে যে শ্রোতারও প্রয়োজন হয় সে তা মনেই করত না। গান গাইতে পেলেই সে খুশী। আর তৃতীয়ত গান গাইবার জন্য যে সামান্যতম সুর ও তালের বোধ থাকা দরকার তা তার ছিলো না। এবং এ ব্যাপারে সে যথেষ্ট অবহিত ছিল।ফলে গান গাইবার সুযোগ পেলে সে অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে সেটিকে গ্রহণ করত। আর আমরাও এটাকে পরম সৌভাগ্য বলে মনে করতাম। আরে বাবা! নাটকের দর্শক জোগাড় করতে হবে তো না কী!!!!!!!
যাই হোক সব জোগাড়যন্ত্রের পর এবং শম্পার অসাধারণ উদ্বোধনী সঙ্গীত দিয়ে শুরু হল নাটক “অচিনপুরের রাজকন্যা”।
দৃশ্যের পর দৃশ্য অভিনীত হচ্ছে। বেচারী প্রম্পটার তাল মেলাতে পারছেনা। মঞ্চ থেকেই লক্ষ করছি পাতা উল্টে উল্টে প্রাণপনে খোঁজার চেষ্টা করে যাচ্ছে ও। প্রতি মুহূর্তে শঙ্কিত হচ্ছি বুঝি বা কেউ পার্ট ভুলে যায় কারন সেক্ষেত্রে প্রম্পটারের কাছ থেকে বিন্দুমাত্র সহযোগিতা পাবার আশা নেই।নাটক প্রায় ক্লাইম্যাক্সে!! এমন সময় মঞ্চে প্রবেশ করল দুই দূত। এরাই তারা যারা অচিনপুরের রাজকন্যার খবর নিয়ে এসেছে। একজন ভাই নিজে আর একজন দলেরই এক সদস্য । নাটকের নিয়মানুযায়ী সংলাপ দুজনের ভাগেই সমান দেওয়া হয়েছিল । কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল ভাই অর্থাৎ প্রথম দূত একাই সব সংলাপ গুলো বলে যাচ্ছে। বারবার ভ্রুকুটি করে,ইশারার মাধ্যমে বুঝিয়েও ওকে নিরস্ত করা যাচ্ছে না। ওদিকে প্রম্পটার নাজেহাল। সে এতক্ষনে ইপ্সিত জায়গা খুঁজে পেয়েছে। দ্বিতীয় দূতকে সাহায্য করতে সে অতিশয় ব্যগ্র। কিন্তু সুযোগ মিললে তো! বেচারী দ্বিতীয় দূত!!! সন্ধে থেকে তার শুধু মুখে রঙ মাখাই সার!! রাজার হাতে সত্যি তরোয়াল থাকলে তখুনি বোধহয় প্রথম দূতের শিরশ্ছেদ হয়ে যেত। কিন্তু সেই মুহূর্তে অসহ্য ক্রোধ দমন করা ছাড়া আর কিছু করার ছিলো না।
যাই হোক । সংলাপ শেষ। এবার দূতেদের প্রস্হানের পালা। সকলেই অবশ্যই জানেন নাটক লেখার সময় চরিত্রের পাশে প্রবেশ/প্রস্হান কথাগুলো লেখা থাকে। এই নাটকেও তা ছিল। এতক্ষন প্রম্পটার এবং দ্বিতীয় দূত কোন ভুমিকা নেবার সুযোগ পায় নি। প্রথম দূত চুপ করাতে তারা এটাকেই শেষ সুযোগ ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এবং প্রম্পটার এই সুযোগে নিজের বিদ্যেবুদ্ধিও কিছুটা প্রয়োগ করতে ছাড়ল না। ফলস্বরূপ দাঁড়ালো কী!! তাদের সংলাপেই বলি
প্রম্পটার: বল বল মহারাজ প্রস্হান।
দ্বিতীয় দুত: বল বল মহারাজ প্রস্হান।
নাট্যকার মূর্ছিত!! দর্শক প্রথমে হতচকিত ।পরে তুমুল হাস্যরোলে নাটকের সেই দৃশ্যের সমাপ্তি।
বাকী রয়ে গেল চাকুরির বিড়ম্বনা নাটকের কথা। তা বলব আগামী সমাপ্তি পর্বে।
অসাধারণ বর্ণনা । মনে মনে ভীষন হাসলাম আর উপভোগ করলাম । পরের পর্বের জন্য অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছি ।
ধন্যবাদ 😊
অসাধারণ Post