“বাগান শুকিয়ে যায়”
✍ ইন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন শিশির গুহ। একটা সময় থিয়েটার করতেন। পরে সিনেমা জগতে অমৃতকুমার।অনায়াসে একটার পর একটা ছবি সুপার হিট।কত নাম ডাক। একটা অটোগ্ৰাফের জন্য হুড়োহুড়ি। কত মহিলার স্বপ্নে উনি নায়ক।
গত তিনমাস তিনি শয্যাশায়ী। এখন জনার্দন ছাড়া ওর পাশে কেউ নেই।
কী সব বলে চলেছেন। জনা একটু ঠ্যালা দিল। বললো কী সব বলছো কর্তা। কিছু টা ঘোরে তাকালেন শিশির গুহ।বললেন কী? জনা বলে ওঠে বলছিলেন তো। “আমার সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল”।
কর্তা বললেন ও। তাই বল। ওটা ‘প্রফুল্ল’নাটকের সংলাপ।বুঝলি জনা। এমনি করেই সাজানো বাগান শুকিয়ে যায়।সকলে জীবনের ফসলটাই নেয়। কৃষককে কেউ মনে রাখে না ।যে ফসল ফলিয়েছিল। এটাই জাগতিক নিয়ম।
হাঁ করে শোনে জনা। কর্তার সব কথায় কেমন একটা হেঁয়ালি। অথচ এই লোকটাই কত মানুষ কে আনন্দ দান করেছে। কতবড় শিল্পী। অজান্তেই কপালে হাত ঠেকায় জনা। ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করে ‘কর্তাকে তুমি ভালো করে দাও’!
শিল্পী শিশির গুহ। কত পুরস্কার পেয়েছেন। সবাই ওদের কুহেলিকার মায়ায় জড়ায় ।তবে ওদের শিরাতে তো জল বয়ে যায় না ।রক্ত ই বয়।শিল্পী জীবনের অপমৃত্যু ঘটে বারবার ।একদিন যাকে নিয়ে হৈ হৈ,হাততালি আর প্রশংসা কালের নিয়মে সব কী তবে পাল্টে যায়?তখন কী নিয়ে বেঁচে থাকবে ?
মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ কাল যৌবনকাল।যেখানে প্রাণশক্তি থাকে ।সৃষ্টির উল্লাস থাকে ।ধন্য করে জীবন ।
তবে স্রষ্টা র মধ্যে কাজ করে অধৈর্য আর অসন্তোষ ।শিশির গুহের মধ্যেও তা ছিল ।এখন তো মাঝরাত্রি ।তাকিয়ে দেখেন অতীতের দিকে ।এখন মনে হয় যৌবনের সেই রঙিন জীবনের ফানুস বার্ধক্যে নেই ।এখন তো শুধু স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে থাকা ।
জনা ভোরে ওঠে ।ওর ও বয়স হয়েছে ।শিল্পী মনের সাথে থাকতে থাকতে ওর চেতনার ও বিকাশ হয়েছে ।বুঝতে পারে কর্তার কষ্ট ঠিক কোনখানে ।হাঁড়িতে গরম জল চাপিয়ে কর্তার কাছে যায় ।
বিছানা থেকে ধরে ধরে নামায় ।গরমজলে মুখ ধুইয়ে দেয় ।বিছানা ঝেড়ে আবার বসানো ।রাতের পোশাক বদলে দিয়ে বাসি জামা লুঙ্গি সাবানজলে ডোবায় ।চোখের আড়াল হবার জো নেই ।জনা জনা করে এমন চেঁচামেচি শুরু করেন ।কর্তামা থাকলে কিছু টা রেহাই হত ।তিনিও সেই যে রাগ করে বাপের বাড়ি গেলেন আর ফিরলেন না ।শিল্পীর বৌ হ ওয়া চাট্টিখানি কথা!ওদের বাঁধা ও যায় না আবার ছাড়াও যায় না ।
যৌবনে জনা শিশির গুহর সঙ্গী ছিল ।আজো আছে ।ও জানে আজ ই যদি ভালো মন্দ কিছু হয়ে যায় মিডিয়া তে ঝড় বয়ে যাবে ।মন্ত্রী আমলারা দুঃখ প্রকাশ করবে ।বড়ো বড়ো শোকসভা হবে ।কিন্তু শিল্পী জীবনের শেষ লগ্নে কী অপরিসীম কষ্ট তা জনা ছাড়া কেউ জানবে না ।
অভিনয় নাকি পবিত্র শিল্প ।নাট্যকার অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় বলতেন ।শিশির গুহ তাই মেনে এসেছেন এত কাল ।তবে জীবন সায়াহ্নে উপস্থিত হয়ে মনে হয় সব মিথ্যে ।প্রতারণা ।প্রেম মিথ্যে,ভালোবাসা মিথ্যে ।সুন্দর রূপ ছিল ।কালস্রোতে সেও মুখ বিকৃত করে ।বুঝিয়ে দেয় কে রে তুই?কী তোর পরিচয়? কীসের এত আস্ফালন?কিচ্ছু থাকবে না ।কীর্তিযস্য স জীবতি। এটাই শাশ্বত ।এগুলো মনে হতেই একটা আনন্দধারা বয়ে যায় । গেয়ে ওঠেন শিল্পী
“বসিয়া আছো কেন আপনমনে
স্বার্থ নিমগন কী কারনে
চারিদিকে দেখো চাহি হৃদয় প্রকাশি
ক্ষুদ্র দুঃখ সব তুচ্ছ মানি
প্রেম ভরিয়া লহ শূণ্য জীবনে”
আজ শরীর টা একটু বিশেষ হয়েছে অমৃতকুমারের ।জানালার কাছে এসে বসেছেন ।বাইরে বৃষ্টির নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখছেন ।বৃষ্টির দিনে মন মেদুর হয়ে যায় ।মনে পড়ে যায় মা এর হাসি মুখ ।ভালো রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতেন মা ।সবসময় উৎফুল্ল । রাবীন্দ্রিক ভাবধারা কখন যে মা মনে গেঁথে দিয়েছিলেন।
মনে পড়ে মাস্টারমশাই দের কথা ।বিদিশা দিদিমণি জাতীয় সঙ্গীত গাইতেন ।গলা মেলাতো ছাত্ররা ।অনেক টা মা এর মতোই হৃদয় জুড়ে ছিলেন দিদিমণি ।বারবার বলতেন ত্যাগ, নিষ্ঠা,ঐকান্তিকতা না থাকলে কিছুতেই বড়ো হতে পারবে না ।সনাতন চিন্তা ।
স্কুলের অনুষ্ঠানে গান গেয়েছিলেন অমৃতকুমার ।তখন তো শুধুই শিশির ।বিদিশা দি বলতেন রবীন্দ্রনাথ কে জানলে তুমি ভারতবর্ষ কে জানবে ।চিরসুন্দরের মরমীয়া পূজারী ।উটের উদাহরণ টা দিতেন ।মরুভূমির জাহাজ ।কত প্রতিকূলতার মধ্যেও জীবন বড়ো ।মনে মনে এসব যখন ভাবছেন ঠিক তখন ই জনা এসে ওই গানটাই চালিয়ে দিল
“খরবায়ু বয় বেগে
চারিদিক ছায় মেঘে
ওগো নেয়ে নাও খানি বাইও”
জনা রে ।তুই আমার প্রাণের কথা কী করে টের পাস।?জনা মুচকি হাসে ।বলে বুড়ো হলে সবাই শিল্পী হয়ে যায় গো কর্তা।
একটা মানুষের জীবন ! কত ঘটনা । কত ঘাত প্রতিঘাত ।কত উত্থান পতন । তবু জীবনকে ভালোবাসতে হবে ।আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধতে হবে । চেটেপুটে খেতে হবে সবটুকু । মৃত্যু তো শুধু দেহটা নেবে । এই অশীতিপর দেহ ।জরায় ভারাক্রান্ত ।মানুষের হৃদয়ভূমি অধিকার করলে মৃত্যুর কতটুকু ক্ষমতা?
আজ শিল্পী হাসছেন ।জনাকে বললেন বুঝলি জনা ।নাট্যাচার্য কী বলতেন । “শিল্প কে যে মানুষ ভালো বেসেছে তাঁর মৃত্যু নেই”।
এখন আমি আলিঙ্গন করবো মৃত্যুকে। এ এক অসীম বোধে উত্তরণ ।বোকা বোকা দৃষ্টিতে কর্তার কথা শুনতে শুনতে জনার চোখে প্লাবণ নেমেছে ।গুনগুন করে শিল্পী গাইছেন
“মরণ রে
তুহু মম শ্যাম সমান”।
–~০০০XX০০০~–