“ফিরে দেখা (দ্বিতীয় পর্ব)”
✍ কাকলি ঘোষ
হ্যাঁ। যা বলছিলাম। নাটকের কথা। ভাবতে অবাক লাগে ওইটুকু বয়সে আমরা নাটক করার কথা ভাবতে পেরেছিলাম। শুধু খেলা নয় ক্রিয়েটিভ কিছু করার চিন্তা সবসময় মাথায় ঘুরত। ছোট থেকেই রূপকথার খুব ভক্ত ছিলাম। বড় হয়ে সে আকর্ষণ কমার বদলে বেড়েছে। রাজপুত্র,রাজকন্যা,পক্ষীরাজ,শুকসারী সে বয়সে যেন জীবন্ত মূর্তিতে ধরা দিত চোখের সামনে। গোড়ার দিকে নাটকের প্রধান চরিত্র ছিল এরাই। মনে আছে প্রথম নাটক লিখি ক্লাশ সিক্সে পড়ার সময়। রূপকথার গল্পই ছিল তার উপজীব্য। কোন এক ডালিমকুমার নামে রাজপুত্রের কাহিনী। যিনি দিনের বেলা মরে যেতেন রাতে আবার বেঁচে উঠতেন রাজকন্যার সাথে মিলিত হবার জন্য।গল্পের এই অভিনবত্বটুকুই আমাকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করেছিল। স্বপ্নের পক্ষীরাজ আর রাশ মানতো না। দুই পাখা বিস্তার করে উড়ে যেত সেই তেপান্তরের মাঠে ,সেই ব্যঙ্গমা ব্যঙ্গমীর দেশে। আসলে গল্পগুলো তখন আর গল্প থাকতো না। কেমন যেন সত্যি হয়ে উঠত।
তো সেই ডালিমকুমারের গল্প নিয়ে লিখলাম প্রথম নাটক। নাম দিলাম ( কেউ হাসবেন না কিন্তু) ‘ দিনে মরে রাতে বাঁচে’। হাসছেন? আসলে ও বয়সে এর চেয়ে ভালো নাম আর মাথায় আসে নি। সেই নাটকও অভিনীত হয়েছিল তবে তা দর্শক সমাজে বিশেষ কৌলিন্য পায়নি।
আমাদের প্রথম সামাজিক নাটক “চাকুরির বিড়ম্বনা”। একটি বেকার ছেলে হঠাৎ চাকরি পেয়েছে। প্রথম মাসের মাইনে পাবার পর তার প্রিয়জনদের এত দাবী তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে যে সে বেচারা একেবারে নাজেহাল। মোটামুটি নাটকের বিষয়বস্তু এই। কিন্তু লেখিকা বেচারি তখন এতটাই অবোধ যে একটা সাধারন চাকরির সর্বাধিক কত বেতন হতে পারে সে বিষয়ে কোন ধারনাই নেই। এখনও মনে আছে সেই নাটকের রিহার্সাল হবার সময় মাইনের অঙ্ক শুনে মেজমামার চোখ কপালে! সে সময় অত টাকা রাস্ট্রপতিরও সাম্মানিক ছিল না। মনে আছে রীতিমত তর্কে নেমেছিলাম। হতেই পারে। না হবার কী আছে? আসলে বিধাতার মত কৃপণ আমি হতে চাই নি। কলম আমার ,কাগজ আমার ,ভাবনাও আমার । তাই দু চারটে শুন্য বেশী বসালে কী এমন ক্ষতি হবে তা আমার মাথায় আসেনি তখন।
আমাদের যাবতীয় খেলাধূলা ও দুষ্টুমির মত নাটক অভিনয়ের জায়গাও ছিলো সেই মামারবাড়ি। একসারি ঘরের লাগোয়া টানা বারান্দা। আর তার সামনে বেশ বড়ো সড়ো একটা উঠোন। বারান্দার কিছুটা জায়গা জুড়ে সারা বছর পড়ে থাকত একটা বেওয়ারিশ তক্তাপোশ। ওইটিই ছিল আমাদের স্টেজ। আর উঠোনে হত দর্শক সমাবেশ। দিদিমা,মামীমা,মাসীদের কাপড় টেনে নিয়ে বানাতাম উইংস,স্ক্রীন। এই স্ক্রীন বানানোর পিছনে ও একটা ছোট্ট কাহিনী লুকিয়ে আছে।থিয়েটারের স্ক্রীন আমাদের চোখে এক আশ্চর্য জিনিস ছিল। কী অসাধারন উপায়ে ওই বস্তুটি তৈরী হোত তার নির্মান কৌশল আমাদের বোধগম্য হোত না। কেবল থিয়েটার দেখতে গিয়ে দেখতাম কী যাদুবলে যেন পর্দা দুপাশে সরে যাচ্ছে। আর ভিতরের জিনিস প্রকাশ্য হচ্ছে। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকতাম। এহেন জিনিস নিজেদের থিয়েটারে করে পাঁচজনকে তাক লাগিয়ে দেবার প্রবল বাসনা। কিন্তু বাসনার পরিতৃপ্তি ঘটে কী উপায়ে? এমন সময় হঠাৎ খবর এলো মানে দলের সদস্যরাই খবর আনলো একজন আছে আমাদেরই আশেপাশে যে না কি এহেন দুর্লভ শিল্পকর্মটি অবহেলায় করে দিতে পারে। ডাক ডাক। খোঁজ খোঁজ। কিন্তু শিল্পীর ভারী গুমোর! সহজে রাজী হতে চায় না।শেষে শর্তাধীন সম্মতি। কী? না — নাটকে একটি প্রধান চরিত্রে অভিনয়ের সূযোগ করে দিতে হবে। অগত্যা। নিরুপায়ের ঢেঁকি গেলা। সেই প্রথম তৈরী হল স্ক্রীন। রোমাঞ্চকর বিস্ময়ে দেখলাম দড়ি ধরে টানলে স্টেজের দুপাশে সরে যাচ্ছে পর্দা। ঠিক পেশাদারী মঞ্চের মত।
ভাবলে এখন অবাক হই কত ছোট ছোট ব্যাপারে কি অনাবিল খুশী লাভ করতাম। শুধু শুধুই আনন্দ! অকারনেই ভাল লাগা! ঘুম থেকো উঠ আকাশ দেখে ভাল লাগা ,বিকেলে খেলার মাঠে হৈহৈ করতে ভাল লাগা,আবার রাতে এক বুক আনন্দ নিয়ে সকালের প্রত্যাশায় ঘুমোতে যেতে ভালো লাগা। তাই সামান্য একটা স্ক্রীন যে আমাদের কচি বুকগুলো আনন্দে ভরিয়ে দেবে এ আর বেশী কথা কী!
স্ক্রীন তো হোল। স্টেজও তৈরী। কিন্তু লাইট মাইক? মামার বাড়ীর বারান্দায় যে 40 ওয়াটের ( সেটাও পরে জেনেছি) বাতি জ্বলত তাতে আর যাই হোক থিয়েটার করা চলে না। এদিকে অভিনেতা অভিনেত্রী থেকে শুরু করে নাট্যকার পর্যন্ত সকলেরই ভাঁড়ে মা ভবানী। কি করা যায়? নাটক তো বন্ধ করার কোন প্রশ্নই নেই। অথচ লাইট মাইক দুটোই দরকার। এখানে একটা কথা না বললেই নয় যে আমাদের এসবে আমরা বড়দের সাহায্য কোনদিন চাই নি। মনেও হয়নি এটা নেওয়া যায় বা যেতে পারে। আর সে যুগে এসবের জন্য টাকা পয়সা চাইতে গেলে অর্ধচন্দ্রের বেশী যে আর কিছু জুটবে না সে জ্ঞান আমাদের ভালোই ছিল। এমতাবস্হায় যখন কী করা যায় ভেবে সকলেরই দিশাহারা অবস্হা …..হঠাৎ একদিন দৈবপ্ররিতের মত সন্টুদাদা এসে হাজির। বয়সে যথেষ্ট বড় এবং দুরসম্পর্কের এই দাদাটির বুদ্ধিসুদ্ধির উপর আমার কোনকালেই আস্হা ছিলো না। আর ওর ওই সবজান্তা স্বভাবের জন্য খুব একটা সুনজরেও দেখতাম না। ভাবভঙ্গি ছিল এমন যেন কোথাকার কোন মুরুব্বি।নিজের তো সরস্বতীর সঙ্গে মোকদ্দমা আর আমাদের দেখলেই তাড়া
” কিরে? খেলছিস? পড়তে বসবি না? কী রে আবার তোদের নাটক? কী রোজ রোজ নাটক করা? পড়ার ক্ষতি হয় না? দাঁড়া পিসীকে বলছি। “.
তাই এহেন একজনের উপস্হিতি আমাকে অন্তত খুশী করে নি। কিন্তু লাফিয়ে উঠল ভাই। আরে! সন্টুদাদার ই তো লাইট মাইকের ব্যবসা! ওকে তোয়াজ করলেই তো ব্যাপারটা হয়ে যেতে পারে।
লেখিকা যে এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র নমনীয় হবে না তা বুঝতে পেরে ভাই ই হাল ধরল। আর আশ্চর্যের ব্যাপার কী করে যেন রাজীও করিয়ে ফেলল বিনা পয়সায় লাইট মাইক সরবরাহের জন্য।
প্রথমে অনড় মনোভাব দেখালেও রাজী হ’তেই হল। গরজ বড় বালাই। আর মুখে কঠোর ভাব দেখালে কী হয় অন্তরে তো খুশীর ফল্গুধারা বইছে! আহা! এমন দিন আসবে কে ভেবেছিলো? লাইট ,মাইক ,স্ক্রীন সব মিলিয়ে একেবারে জমজমাট ব্যাপার। কিন্তু জানি না কেন মনের মধ্যে অকারন একটা বিজাতীয় অস্বস্তি লেগে রইল। আর সেটা যে কতখানি সত্যি তা টের পেলাম নাটকের দিন। সে কথা আজ আর নয়। যথাসময়ে বলা যাবে।
(এরপর…ক্রমশ…)
অসাধারণ !!! ….. অনবদ্য !!! …….