“ডাকাবুকো”
✍ ইন্দ্রানী বন্দ্যোপাধ্যায়
ডাকাতের মতো বুক যার তাকে ডাকাবুকো বলে।মাস্টার মশাই ক্লাসে বললেন। কথাটা শুনে ক্লাসের মধ্যেই ফিক করে হেসে উঠল অক্ষয়। মাস্টার মশাই সুদীপ্ত সান্যাল ছাত্রের দিকে তাকালেন।
সুদীপ্ত সান্যাল স্যার বেশ রাশভারী মানুষ। ছাত্র ছাত্রী তাঁকে ভয় যেমন করে ভক্তিও করে। সারা ক্লাস অক্ষয়ের দিকে তাকিয়ে – ইসস। কী সাহস। এখনি নিশ্চয় ই পিঠে তাল পরবে। চেয়ার ছেড়ে অক্ষয়ের দিকে চলেছেন। অক্ষয় ঘটনার অকস্মিকতায় হতভম্ব। কেন যে পিসির কথাটা হঠাৎ মনে এল। কাঁচুমাচু হয়ে স্যার এর গতিবিধি নজর করছে ও নিজেও।
সুদীপ্ত স্যার অক্ষয় কে বললেন বলো। কেন হাসলে?
অক্ষয় উঠে দাঁড়িয়ে আমতা আমতা করতে লাগল। তারপর বললো স্যার। পিসির কথাটা মনে পড়ে গেল।
‘পিসির কী কথা অক্ষয়’?
শান্তভাবে জিজ্ঞাসা করলেন। বাকি শিক্ষার্থীদের কৌতূহল ক্রমশ বাড়ছে।
অক্ষয় বললে আমার পিসিকে বাবা ডাকা বুকো বলে যে।
অক্ষয় এর কথায় সুদীপ্ত বাবু বললেন তোমার পিসি খুব সাহসী বুঝি?
স্যারের কণ্ঠে দরদের আভাস পেয়ে অক্ষয় তরতর করে বলে চললো পিসির গল্প।
অক্ষয় এমন ভাবে বলল যে স্যার আপ্লুত হয়ে গেলেন।
জানেন স্যার। আমরা জাতিতে গোয়ালা। চাষজমির পাশাপাশি গোয়ালে গাই আছে কুড়িটা। কিন্তু বাবা আমার হাড় কেপ্পন।
সুদীপ্ত সান্যাল চমকে উঠে বলেন ছি অক্ষয়। বাবা সম্পর্কে এমন বলবে না। দ্বিতীয় দিন যেন না শুনি।
অক্ষয় বললো জানি স্যার। তবে বলতে হল। উনি বলেন আর পড়তে হবে না। ফাল্তু পয়সা খরচ করে কী লাভ। গরু দেখাশোনা কর। কোনদিন যদি হিসেবের কম দুধ হয় তবে সম পরিমাণ জল মেশান।
আমার পিসি খুব ডাকাবুকো স্যার। আর পিসিকে খুব ভালোবাসি। বাবা পিসি কে প্রায় ই বলে তোকে এটা দেবো,ওটা দেবো। গত একবছর ধরে বলে আসছে তোকে একটা দুধেল গাই দেবো। কিন্তু গতকাল হয়েছে কী! বাবা মাঠে গরু গুলো বেঁধে রেখে এসেছিল। পিসি মাঠ থেকে গরু নিয়ে সোজা নিজের বাড়ি। বাবা গরু খুঁজছে। কোথায় গেল অমন দামী গরু। পিসি লোক মারফত খবর পাঠিয়েছে।অনেক কাজে ব্যস্ত তোরা। গরু দেবার সময় পাচ্ছিস না। তাই মাঠ থেকে নিয়ে এসেছি।
ছাত্র ছাত্রীরা অক্ষয়ের গল্প শুনে হাসতে লাগলো। সুদীপ্ত বাবুর হাসি পাচ্ছিল। তবে চেপে গেলেন। এর মধ্যেই দ্বিতীয় ঘন্টা শেষ হল।
ক্লাস থেকে স্টাফরুমে এসে অক্ষয়ের কথাটা মনে মনে ভেবে হাসছিলেন। বাস্তবিক ডাকাবুকো না হলে পদে পদে ঠকতে হয়। আবার এটাও ভাবলেন যে ছোটদের আমরা ভাবি ওরা কিছু বোঝে না। অক্ষয়ের কথাগুলো কিন্তু তা বলে না।
বাড়ি ফিরে ঘরের মধ্যে মা এর ছবিটার দিকে চোখ যায়।মৃণালিনী দেবী।সুদীপ্ত সান্ন্যালের চরিত্র গঠনে এই মানুষ টার প্রভাব।কী অসীম সাহসী ছিলেন মা।অন্যায়ের সাথে কখনও আপোষ করেন নি।
ঘরে ঢুকে হাত পা ধুয়ে পোশাক টা পাল্টালেন।মাথায় অন্য চিন্তা ঘুরছে।মনে পড়ে গেল একটি বিশেষ ঘটনা।মা এর মুখে শোনা।আজকের ক্লাসে একটা মাত্র শব্দ কত রূপ নিয়ে আবির্ভূত।
যে সময়ে মেয়েদের বিয়ে আর সন্তান উৎপাদন ছিল মনুষ্য জন্মের সার্থকতা সেই সময় মা সকলের শ্যেন দৃষ্টি উপেক্ষা করে লেখাপড়া করতেন।পাড়া প্রতিবেশী থেকে আত্মীয় স্বজন ঠোঁট ওল্টাতো।শুনতে হত মেয়েদের এত ধিঙ্গিপনা ভালো নয়।
আজ মা নেই।তবে সত্যি বলার সাহস সঞ্চারিত করে গেছেন পুত্রের মধ্যে।অক্ষয়ের পিসির মতো মা তো ডাকাবুকোই বলা যায়।এরকম সাহসের ঘটনা মা এর মুখে শোনা।
মৃণালিনী দেবী কমলা হাইস্কুলের বাংলার শিক্ষিকা।ওখানে ও পুরুষ শাসিত সমাজের হুমকি ছিল।এখন কার মতো ম্যাটারনিটি বা চাইল্ড কেয়ার লিভ তখন ছিল না।সুদীপ্তর জন্মের দুই মাস কুড়িদিন পরেই জয়েন করতে হল।
স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা চলছে তখন।প্রধান শিক্ষক নির্মাল্য বাবু মা কে স্নেহ এবং সমীহ করতেন।সেদিন পরীক্ষা হবে চারটে চল্লিশ পর্যন্ত।কিন্তু সাড়ে চারটে তে না গেলে ট্রেন পাবেন না।খুব চিন্তা।ছেলেটা কাঁদবে।ব্রেস্ট ফিডিং এর ব্যাপার আছে।কাতর মা প্রধান শিক্ষককে জানালেন।উনি সঙ্গে সঙ্গে ছুটি দিয়ে দিলেন।বললেন শিশুর কথা ভেবে আপনাকে দশ মিনিট আগে ছাড়লাম।যদি অসুবিধা হয় আমি তো আছি।আপনার কাজ আমি করে দেবো।
আমরা তো মুখে কত বড়ো বড়ো বুলি আওড়াই আদর্শের।কাজের ক্ষেত্রে কতটুকু করি।মৃণালিনী দেবীর দশ মিনিট আগে যাওয়া নিয়ে পুরুষ সিংহ মাস্টার মশাইরা ঘোঁট পাকাতে শুরু করলেন।যেন এমন ভাব যে প্রধান শিক্ষককে নাস্তানাবুদ করা যাবে।আর কিছু দিদিমণি বললেন মৃণালিনী মোহিনীবিদ্যায় পারদর্শী। হেড কে বশীকরণ করেছেন রূপের জাদু দিয়ে।
অ্যাপ্লিকেশন তৈরি।স্টাফ কাউন্সিলে মিটিং ডাকা হল।এখান থেকে ব্যাপারটা ম্যানেজিং কমিটি তে যাবে।স্টাফ কাউন্সিলের সেক্রেটারি মহম্মদ ইকবাল।মানুষ টা খারাপ নয়।মৃণালিনী কে বহিন ডাকে। তবে দশ চক্রে ভগবান ও ভূত হয়।
মৃণালিনী দেবী জানতেই পারেন নি।তাকে আর হেড স্যার কে নিয়ে এত কিছু হচ্ছে।যেদিন মিটিং সেদিন স্কুলে এসে নির্মাল্য বাবুর মুখ থেকে আদ্যোপ্রান্ত শুনে হাঁ হয়ে গেলেন।আর আশ্চর্য হলেন যে দিদিমণি রা কাজ বললেই অসুখের বাহানা দেখান তাদের কোনো অসুখ নেই আজ।যেন নব আনন্দে জেগে উঠেছেন।দাঁতে দাঁত চেপে মৃণালিনী দেবী প্রস্তুত হলেন।তিনি জানেন।অন্যায় যত প্রবল ই হোক।আসলে সে ভীরু।
মিটিং শুরু হল ।ঘড়িতে আড়াইটে বাজে।দিদিমণি এবং মাস্টারমশাই রা বসে পরেছেন সুবিধা মতো স্থানে।করণিক শৈবাল ঘোষ একটু ঠোঁটকাটা। প্রধান শিক্ষক কে বললেন “স্যার, ক্লাসে যেতে দশ মিনিট দেরি হলেও ঝগড়ার ইসু পেলে এরা এত সক্রিয় হয়ে যান।”
মুচকি হাসলেন নির্মাল্যবাবু। একটু পরে কী যে হবে তাই নিয়ে কিছুটা চিন্তিত।
ইকবাল স্যার কে ঘিরে শোভা ম্যাডাম, অনসূয়া দি,আর উষা দি।কী যেন বোঝাচ্ছেন হাত পা নেড়ে।ঠিক এই সময় হেড স্যারের সাথে সহকারী প্রধান শিক্ষক এবং করণিক শৈবাল ঘোষ প্রবেশ করলেন।একপাশে এসে বসলেন মৃণালিনী দেবী।রাগে, দুঃখে, অপমানে ভিতরটাতে কষ্ট হচ্ছে। মিটিং শুরু হল।
প্রধান শিক্ষক অভিযোগ পত্র টি পড়লেন। সেখানে সারমর্মটা এই আপনার আচরণ পক্ষপাতদুষ্ট। অগণতান্ত্রিক ও বটে।আপনি নিয়ম রক্ষার কথা বলেন এবং আপনিই আবার নিয়ম ভাঙার কারিগর।বিশেষ কাউকে আপনি পরীক্ষা চলাকালীন দশমিনিট আগে ছেড়েছেন।যা নিয়ম বিরোধী।
অভিযোগ পত্রটিতে মৃণালিনী দেবী ছাড়া সকলেই স্বক্ষর করেছেন।প্রধান শিক্ষক স্টাফ কাউন্সিলে্য সেক্রেটারি কে বললেন আপনি নামটা বলুন।কাকে আমি অতিরিক্ত সুবিধা দিই। ইকবাল স্যার আমতা আমতা করতে লাগলেন।বললেন নামটা উহ্য ই থাক।সকলেই এমন মুখের ভাব করে বসে আছেন যেন আচ্ছা যাঁতাকলে ফেলেছি হেড কে।বোঝ এবার বাছাধন।
প্রধান শিক্ষক যখন বার বার বলছেন নামটা প্রকাশ করতে তখন উঠে দাঁড়ালেন মৃণালিনী দেবী।দৃপ্ত ও মধুর কন্ঠ বেজে উঠলো ঘরটাতে।তখন নাম প্রকাশিত হল।
মৃণালিনী দেবী বললেন বিদ্যালয় নিয়ম অনুযায়ী চলে না।এটি ধর্ম নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান।কিন্তু প্রতি শুক্রবার বারোটার পর আপনি এবং শাহনাওয়াজ বাবু নামাজ পড়ার নাম করে স্কুলের অদূরে মসজিদে যান।ম্যানুয়েল খুলে দেখতে পারেন এটা নিয়ম আছে কি না।আমি কোনো ধর্মের বি্রোধিতা করি না।কিন্তু সদ্যোজাত শিশুর থেকেও কী ওটা অধিক প্রয়োজনীয়?আমরা মা এরা শিশুকে নারায়ণ ভাবি।একজন মা তাঁর সন্তানের জন্য দশ মিনিট সময় ভিক্ষা চেয়েছিল।সভায় সবাই চুপ। পিন পড়লে আওয়াজ শোনা যাবে।
মৃণালিনী দেবীর চোখে জল চিকচিক করছে।হায়!এনারা এই হৃদয় নিয়ে মানুষ গড়বেন।মানবতার লজ্জা।করণিক শৈবাল ঘোষ বলে উঠলেন তবে তো প্রতি শুক্রবার এ নামাজ পড়তে ক্লাস ফাঁকি দেওয়া নিয়ম বিরোধী।কী বলেন স্যার?
প্রধান শিক্ষক বললেন সব নিয়মে বাঁধতে গেলে তাই বোঝায়।একটা চাপা গুঞ্জন হচ্ছে।প্রধান শিক্ষক একটু উদাস ও বিমর্ষ। মৃণালিনী নিজেকে সামলে নিয়ে আবার মুখ খুললেন।
ইকবাল বাবু।আপনি আমাকে বহিন বলেন ।একবার ভেবে দেখবেন দুপুর বারোটায় গিয়ে একটা কুড়ি নাগাদ ফিরতেন।টিফিনের আগে দুটি ক্লাস নিয়ে আপনার অনন্ত অবসর।আর আমি।গর্ভে সন্তান নিয়ে ভারী শরীর নিয়ে পরপর চারটে ক্লাস এই বহিন করতো। কারণ আমি জানি Education is the another name of adjustment.
এবার প্রধান শিক্ষক মুখ খুললেন।বললেন একথা প্রমাণিত যে সুবিধা আপনারা সবাই নেন।সব পাখি মাছ খায়। দোষ হয় মাছ রাঙার। মিটিং শেষ হল।
এমনি করেই মৃণালিনী দেবী বার বার জয়ী হয়েছেন।কাজের প্রতি তাঁর নিষ্ঠা, ঐকান্তিকতা তাঁকে একটা সফল নারী তে পরিণত করেছিল।
আজ বড়ো মনে পড়ছে মা এর কথা। জীবনের সেরা শিক্ষক মা।ডাকাবুকো, স্পষ্টবাদী, একগুঁয়ে আর স্বাধীন চেতা।
ঠিক সময়ে স্কুলে আসেন সুদীপ্ত সান্ন্যাল।স্নেহে পরিপূর্ণ দুটি হাত বাড়িয়ে থাকেন ওই ম্লান মুখগুলোর দিকে।ওরাই ভারতবর্ষ।আর বিদ্যালয় টা সেই গুলবাগ। যেখানে হিন্দু,মুসলমান, খ্রিস্টান, আদিবাসী সব ফুল হয়ে ফুটে আছে। সুদীপ্ত বাবু জল সিঞ্চন করছেন, সার প্রয়োগ করছেন। এই বিদ্যালয় বাগানে মালি তিনি।তৈরি হবে আগামী দিনের নাগরিক। সব মা বলে গেছেন।
এইসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ নজরে পড়ল আরতি ম্যাডাম ক্লাসে যাচ্ছেন। গর্ভে তাঁর সন্তান। মলিন মুখে চক ডাস্টার নিচ্ছেন।ওনার মুখের বেদনা একদিন তাঁর মা এর মুখে ছিল ।হঠাৎ কী মনে হল।ছুট্টে গিয়ে চক ডাস্টার টা চেয়ে নিলেন।বললেন।আরতি দি।আপনি বিশ্রাম নিন। আমি এখন অফ আছি।আপনার ক্লাসটা আমি নিয়ে নিচ্ছি।আরতি দির চোখে সেই মাতৃত্ব।অবাক হয়ে তিনি দেখছেন ক্লাস নিতে যাচ্ছেন সুদীপ্ত সান্ন্যাল।শিপ্রা দি আরতি কে জিজ্ঞেস করলো।কী দেখছো আরতি?আরতি দি অশ্রুসজল চোখে বললেন ভারতবর্ষ দেখছি ।
–~০০০X X০০০~–
মমতাময় এবং প্রতিবাদী চরিত্রের কাহিনীটি মনোজগতকে নাড়া দিয়ে যায়। মানবিক আবেদন সুপরিস্ফুট।
নামকরণ সার্থক। লেখিকাকে আমার আন্তরিক অভিনন্দন। এইরকম একটি অসাধারন লেখা উপহার দেওয়ার জন্য।