“ভূতের খপ্পরে”
✍ ইন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
বন্ধুদের ভূতের গল্প শোনাবো। সত্যি ঘটনা। আমার আপন পিসেমশাই এর মাসতুতো ভাই এর খুড়তুতো বোন এই গল্পটা বলেছিল। আমার সাদা মনে কাদা নেই। সত্যি কথাই বলছি।ভূতের ভয়টা আছেই আছে। মানুষ ভূত নিয়ে আমার কোনো কালেই মাথাব্যথা নেই। ওরা বেয়াদপি করলে ঘ্যাচাং ফু। আমার এক বন্ধুকে দেখেছি একটা মানুষ ভূতের জন্য কাঁদতে।ছো ছো ছো। শরম কি বাৎ। আমার চোখের জল অত সস্তা নয়। তবে সত্যিকারের ভূত হলে তার সাথে গান করবো
“কেঁ পেরথম কাঁছেঁ এঁয়েঁছি”।
আআ হাআআ।
গল্পটা অনেক কাল আগের। তখন পাড়া গাঁ তো পাড়া গাঁ।শীতকালের রাত। পাশের গাঁ তে যাত্রা হচ্ছে রেললাইনের উপর দিয়ে পথ। অন্ধকার অমাবস্যা। আমাদের পাড়ার বিভূতি ঘোষের দাদু যাত্রা দেখে ফিরছিল।” সীতাহরণ”পালা। অ্যামেচার পার্টি। নেপাল ভটচাজ সীতা সেজেছিল।উফফ। কে বলবে পুরুষ মানুষ। রাম রাম করে যখন ডাকছিল তখন দর্শকরা কেঁদে আকুলিবিকুলি।
বিভূতিকাকার বয়স পঞ্চাশ। তার দাদু পঞ্চানন। যাত্রা শুনে রাম রাম গানটা করতে করতেই আসছিল। তেনাদের তো আবার ওই নামে অ্যালার্জি। তবে পঞ্চানন টের পাচ্ছিল কারা পিছু নিয়েছে। সতীশ ময়রা বলেওছিল। এসেছো তো নাচতে নাচতে। এখন ফিরবে কীভাবে। পঞ্চানন বুক ফুলিয়ে বলেছিল
“ভূত আমার পুত
পেত্নি আমার ঝি
রাম লক্ষণ সাথে আছে
করবে আমার কী”।
সতীশ বলেছিল আস্ফালন তো দেখছি মন্দ নয়।জানো তো কদিন আগে রেললাইন এ কাটা পরেছে একটা লোক।উত্তরে পঞ্চানন বলেছিল আমার ধর্মপেত্নি যখন কিছুই করতে পারে নি তখন এ ভূতে কিছু করতে পারবে না।
পঞ্চাননের ওই একজনকেই ভয়। ওর বৌকে। বাপরে।নাম কী।বজ্রজ্বালা। রামায়ণ পড়ে ওর মামাদাদু নামটা রেখেছিলেন।কুম্ভকর্ণের স্ত্রীর ওই নাম ছিল। পঞ্চানন আদর করে বলে বাজু।বৌ বারবার করে বলে দিয়েছে রাত্রে প্রকৃতির ডাক এলে তাদের আস্তানায় খবরদার নয়।
লাইন ধরে আসতে আসতে পঞ্চানন দেখলো একটা পাথর।বেশ বড়। মাথায় বুদ্ধি চাগার দিল। এটাকে নিয়ে গিয়ে পুকুর ঘাটে রাখবো। কাপড়কাচা, বাসনমাজার পাশাপাশি মাছ ধরবে পাথরে বসে।আর একজন সাথে থাকলে ভালো হত।খুব ভারী। একা পাথরটা তুলতে বেশ বেগ পেতে হল।পঞ্চাননের কোমড়ে সবসময় একটা গামছা থাকে।তখনকার দিনে এটাই ছিল দস্তুর। ওটা মাথায় বিঁড়ে করে পাথরটা তুলতে গিয়ে বুকে একটা ব্যথা অনুভব করলো। যাইহোক।বেশ খুশি হবে সবাই বিশেষ করে গাঁয়ের বৌ ঝি রা।এই ভেবে সে নিয়ে চলল ভারী পাথরটা।রাতের গভীরতায় নির্জন রাস্তাতে কেউ নেই।নাহলে দেখতে পেত পাথরের উপরে সাদা কাপড় পরে পা ঝুলিয়ে বসে আছে।বুদ্ধু পঞ্চানন।অত ভারী পাথরটাকে হাঁপাতে হাঁপাতে নিয়ে চলল।
রাত তখন একটা। পুকুরঘাটে পাথরটা নামালো।হঠাৎ একটা ঠান্ডা হিমশীতল হাওয়া বয়ে এল।সঙ্গে একটা হাসির আওয়াজ।পঞ্চানন ভাবলো ওটা মনের ভুল।সতীশ ময়রার কথাটা একবার মনে উদিত হল। তারপরেই ভাবল ধুসস।ভূত বলে কিছু নেই।এবার বাড়িতে গিয়ে বাজুসুন্দরীর রাগ ভাঙাতে হবে।খুব অভিমানী।
পরের দিন সকালে মেয়ে মহলে হৈহৈ।কী সুন্দর চকচকে একটা পাথর।অনেকটা চটালো।দুজন ভালোভাবে পাশাপাশি বসা যাবে।সংসারে সুখ দুঃখের দুটো কথা কয়ে শান্তি।কাপড় কাচা,বাসন মাজা সব সুন্দর হবে।পঞ্চাদাদুর জয়জয়কার।পাড়ার ছেলেরা পাথর থেকে লাফিয়ে পরছে জলে।তবে পঞ্চাননের বুকের ব্যথাটা মাঝেমধ্যে চিনচিন করে জানান দিচ্ছে।সবাই আনন্দিত হলেও বজ্রজ্বালা রেগে টং।কী দরকার ছিল ওই পাথরটা বয়ে আনে।এমন আহাম্মক ওর কপালে জুটেছে।বোকার হদ্দ।
গোপালের ঠাকুমা ঠাকুরের বাসন মাজবে বলে পুকুরঘাটে গেল।এই সময় ঘাট ফাঁকা।ঠাকুরদেবতা বলে কথা।বিচার আচার আছে।মাথা নিচু করে হাঁটছিল।পাথরের কাছে এসে জল দিয়ে পাথরটা ধুতে হবে।মাথা উঁচু করতেই দাঁত মুখ ছরকুটে সেই যে পড়লো একেবারে অজ্ঞান।আওয়াজ টা বাজু পেয়েছিল।দৌড়ে গেল পুকুরঘাটের দিকে।ওই দিক থেকেই একটা গোঙানির আওয়াজ।
গ্ৰামে ভূতের দাপট বেড়েই চলেছে।পঞ্চানন এসব বিশ্বাস করে না।বাজুর কথায় আমল ই দেয় না।অমন পাথর ।চকচক করছে।কত সুবিধা।কদিন ধরে অবিশ্রান্ত বৃষ্টির পর আজ একটু ধরণ করেছে।খ্যাপলা জালটা নিয়ে পঞ্চা গেল।মাছ ধরতে হবে।কতদিন মাছ ধরে নিও।
পুকুরের মাছ ধরা বেআইনি।কেষ্ট জেলে পুকুর টা চাষ করে।চুক্তি অনুযায়ী ভাগীদার দের মাছ দেয়।কিন্তু শুনলে তো।নিস্তরঙ্গ গ্ৰাম্য জীবনে এগুলো যদি না থাকে তাহলে কেমন বিস্বাদময় হয় জীবনটা।
পঞ্চা জালটা ফেলতেই একটা বড় কাৎলা মাছ পেল।প্রায় তিন কেজি ওজন হবে।একটু অবাক হল।মাছটা নিয়ে বাড়ি এল।দেখলো পাথরের উপরে সাদা কাপড় পরে কে যেন বসে আছে।বুকটাও আবার চিনচিন করে উঠল।আসলে বড় মাছে টান লাগলো।
মাছটা বেছে ধুয়ে বাজুর কাছে গিয়ে বলল কটা মাছ ভেজে দাও।এখনি খাবো।বাজখাঁই গলায় বাজু চেঁচিয়ে উঠল।মরণদশা।বলি ভূতে ধরেছে তোমায়।মাঝরাতে মাছভাজা।
কাঠের উনুনে কয়েকটা ঘুঁটে দিয়ে আগুন জ্বালাল পঞ্চা।কী বড় মাছ।চারটে মাছ ভাজবে।বাজু রেগে আছে।তাই নিজেই ভেজে খেল।
সকালে বাজু বাসি কাজ সেরে রান্নাঘরে ন্যাতা দেবে বলে যেই গেল দেখল উনুনের পাশে পড়ে আছে পঞ্চাননের দেহ।নিথর আর নিষ্কম্প।একটা কালো বেড়াল ছুটে পালাল।ডাক্তার বলল হার্টফেল করেছে তিনঘন্টা আগে।কান্নায় ভেঙে পড়ল বাজু।গোটা গ্ৰাম হতভম্ভ।
পারলৌকিক কাজ মিটে গেলে পাথরটাকে গ্ৰামের লোকেরা রেললাইনের ধারে রেখে এল।তারপর আর ভূতের উপদ্রব হয় নি।তবে ভয়ে কেউ মাছ চুরি করতে যায় না।
———::X::———