(আমরা পত্রিকার পক্ষ থেকে সবাই আপনার দ্রুত আরোগ্য কামনা করি।)
// চেতনায় নজরুল //
***************
✍ শ্যামাপ্রসাদ সরকার
ছোটবেলাটায় দুখু মিঞাকে যখন চিনেছি তখন তার সাথে কাজী নজরুলকে মিলিয়ে চেনার দরকার ছিল না। দুখু আমার একলা শৈশবযাপনের সঙ্গী। তার লিচু চুরির গল্পটা আমায় বলেছিল ছড়ার মত করে। তার সেই অজপাড়াগাঁয়ের কোন এক খুকি নাকি কাঠবিড়ালির সাথে গল্প করত সেকথাও বলতে সে ভোলেনি।
দুখুরা খুব গরীব। বেচারাকে সেই বয়সেই রুটির দোকানে কাজ করতে হত। আমার মত বয়সেই তার রোগাসোগা হাতে মেহনতের কামাই উঠে এসেছিল নিতান্ত দায়ে পড়েই। খুব ভাল বাঁশী বাজাত সে। গানের গলাটিও ছিল বেশ। জামরুল গাছের একটা হেলে পড়া ডালের ওপর বসে মূলতানেতে সে কত বাঁশী বাজিয়েছে! জৈষ্ঠ্যের ঝড়ের দামালপনা তার বুকের ভেতর। তাই একদিন লেটোর দলে পালাল ঘর ছেড়ে। সুরের নেশা ধরল সেদিন তাকে।
একটু বড় হবার পর অনেকদিন তাকে শুধু কাজী নজরুল বলেই চিনতে শিখেছিলাম। দুখুর জন্য আর মন কেমন করত না। বরং বেড়ে ওঠার ওই বয়সটাতে কাজীর কবিতাগুলো বেশ লাগত। সাদা পোশাকের প্রভাতফেরীতে –
” মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম…….” রবিঠাকুর তো কাছছাড়া হননি কখনো।তবে মাস্টারমশাইদের আগ্রহে এবারে বাড়তি পেলাম কাজীকবিটিকে।
সময়টা উত্তাল তখন। ক্লাস সেভেনের নুরুল যেদিন খাদ্য আন্দোলনের মিছিলে গুলি খেল সেদিন আমরা সবাই সমবয়সী ছেলেরা হঠাৎ বড় হয়ে উঠেছিলাম। শহীদের মা’ বোনেদের ক্ষতে তখনো কি নজরুলের ‘তাজা খুনে লাল’ হয়ে যাওয়া সরস্বতীর শ্বেতকমলের প্রলেপ পড়তো? এ প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজেছি।
চোখ বুজলে মধ্যপ্রাচ্যের রণাঙ্গনের ছবিটা ভাসে। স্বপ্নালু দৃষ্টি মেলে এক যুবক যুদ্ধ শিবিরে বসে ‘বাউন্ডুলের আত্ম কাহিনী ‘ লিখছে। তার সেই উদাসী দৃষ্টিতে গান, দেশ, প্রেম ও ভগবান এক হয়ে যাচ্ছে সে টের পাচ্ছেনা কিন্তু!
মুস্তাফা ছিল আমাদের কলেজবেলার সাথী। মুষ্ঠিবদ্ধ হাত উঁচু করে খুব আবৃত্তি করত
‘কান্ডারী হুঁশিয়ার’! একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের আগুন তাকে ‘অগ্নিবীণা’র সুরে সেদিন টেনে নিয়ে গেছিল। মর্গ থেকে আমরা যখন ওর ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া দেহটা নিয়ে সবে ফিরেছি, তখন কার্তিক মাসের সন্ধ্যারাতের মনখারাপের গন্ধে মাতাল ওদের ছাতিমতলায় এসে একান্তে দাঁড়িয়েছিলাম। মনে মনে বলেছিলাম – ‘ বন্ধু আমি তোমায় পেয়েছি’!
নিবারণ মাস্টার প্রফেশনাল বোর্ডে থিয়েটার করত। হঠাৎ একদিন টি বি ধরা পড়ল মাস্টারের। রোগ আ অর্থাভাব দুটোই তীব্র তখন। যাদবপুর থেকে ওষুধ নিয়ে ফেরার পর দেখতাম উজ্জ্বল চোখের নিবারণ মাস্টার ক্রমশ নিভে আসছে। কথা বলতে গেলে কাশির সাথে রক্ত ওঠে। চুপ করে ঝিম মেরে পলেস্তারা খসে যাওয়া দাওয়ায় বসে থাকতে থাকতে কখন যেন ফুলের জলসার সেই নীরব কবিটি হয়ে উঠত সে। তাঁকে অস্বীকার করে চলি সে সাধ্য কি!
মালতী যখন সাঁঝবেলায় বাজারের একটা মহল্লায় আলগা খোঁপা এলিয়ে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াত, জন্নতের হুরীপরীকে দারিদ্র আর অপমানের প্রসাধনের মধ্যেও তাকে কিন্তু চেনা যেত ঠিক। তার নার্গিস বনে কোনও বুলবুল আসেনি এজন্মে। শেষে কুষ্ঠ হয়ে গলির মুখে বিকৃত দেহে তাকে অনেক পরে ভিক্ষা করতে শুনেছি। তার কম্পিত জিহ্বা আমৃত্যু স্পর্শ করত কবেকার তার শেখা গানটাকে…..
‘তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি / একি মোর অপরাধ….’
কবি এখানেই জিতে গেছেন। বড় বড় মানপত্রের অসার জঞ্জাল দিয়ে তাঁকে ঘর ভরাতে হয়নি। মানুষের বুকের মধ্যে তিনিই ঘর বেঁধেছেন।
তাঁর কন্ঠ নীরব করবে এমন সাধ্য কার?
**************