✍ সলিল চক্রবর্ত্তী
লেখক পরিচিতি :-
সলিল চক্রবর্ত্তী যিনি এমন একজন বাঙালি লেখক, তিনি তার প্রতিটি সাবলীল লেখার মাধ্যমে বার বার সমাজের প্রতি একটি সুন্দর বার্তা বহন করেন। সৃষ্টিশীল এই লেখক অতি সূক্ষ ঘাটনাদি বিশ্লেষণ করে এক রসবোধাত্মক মুহূর্তের আস্বাদ দেন তার লেখার মাধ্যমে।
“বাস্তু”
“আজ বাড়ি ফেরার সময় কিছু নিয়ে আসবে, খালি হাতে ফিরবে না।” – দরজার সামনে দাড়িয়ে আটপৌরে শাড়ি পরে কপালে সিদুর দিয়ে অর্ধ সাজে স্বামীর হাতে পান্তা, পিয়াজের পাত্রটা দিয়ে একগাল হেসে কথাটা বলল টগর। গোপাল শুধু ‘হুম’ বলে গামছায় বাঁধা পোটলাটা স্ত্রীর হাত থেকে নিয়ে মাঠের দিকে রওনা হল।
দাসপুর গ্রাম। তারকেশ্বর থেকে মাইল আটেকের পথ দু-চারটে পরিবার ছাড়া বেশীর ভাগই চাষী পরিবার।গোপালের জন্মও চাষী পরিবারে। বাবা অল্প বয়সে মারা যান। মা অতিকষ্ঠে পরের বাড়িতে কাজ করে ছেলেকে মানুষ করেন। গোপাল লেখাপড়া বিশেষ করতে পারেনি ঠিকই কিন্তু ওর মা ওর বাবার এক ফোঁটা পৈতৃক জমিও নষ্ট করেননি। বছর ছাব্বিশের গোপালের চেহারা বেশ মজবুত। যেমন লম্বা তেমনই ঠিক মানানসই বুকের ছাতি। আর গায়ের শক্তি? ডাকাত পড়লে চার-পাচজনকে গোপাল একাই রুখতে পারবে। বন্ধু-বান্দব পুলিশ, মিলিটারিতে নাম লেখাতে বলে কারন তাতে নাকি চাকরি ওর বাধা। কিন্তু গোপাল অতি সাধাসিধে সচ্ছল ছেলে। মাকে এক ছেড়ে সে গ্রামের বাইরে যাবেইনা। একবার তো পঞ্চায়েত প্রধান পরেশবাবু নিজে এসেই গোপালকে প্রস্তাব দেন যাতে তার রাজনৈতিক দলে গোপাল যোগ দেয়। সেখানে পয়সাকড়ি ভালই আমদানি আছে। পঞ্চায়েত দখলে থাকলে একটা চাকরিরও ব্যাবস্থা হয়ে যাবে। গোপাল তাতে সন্মতি না দিয়ে বলে “না কাকা, ও আমার দ্বারা হবেনা।” পরেশবাবু না করার কারন জানতে চাইলে গোপাল নির্ভয়ে নিদ্বিধায় বলে “কাকা, রাজনীতি করলে সাদা কে সাদা, কালোকে কালো বলা যায় না। ওর থেকে আমার চাষাবাদই ভালো।”
বছর পাঁচেক আগে মা নিজে পাশের গ্রাম থেকে টগরকে পছন্দ করে ঘরের বউ করে এনেছেন। নিজে তো জীবনে দাম্পত্য সুখ পাননি। তাই ছেলে-বৌ কে দেখে যদি একটু শান্তি পান। কিন্তু বিধি বাম। হঠাৎ এক অজানা রোগে এক সপ্তাহের মধ্যে সব শেষ। টগরও ওই সময় খাওয়া ঘুম ত্যাগ করে শাশুড়ির সেবা করেছে কিন্তু ফল কিছুই হয়নি। গোপাল খুব ভেঙ্গে পড়ে। মা ই তো তার জগৎ ছিল। পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধবরা ওকে অনেক বোঝায় যাতে ও ভেঙ্গে না পড়ে। মা বাবা তো কারো চিরকাল থাকে না। বরং ঘরে একটা বাচ্চা-কাচ্চা এলে আস্তে আস্তে সব ভুলে যাবে। কিন্তু সেখানেও ভগবান মুখ তুলে চাইলেন না। আজ বছর পাঁচেক হতে চলল টগরের কোল আলো করে কোন সন্তান এলো না। টগরের মা অনেক ডাক্তার-কবিরাজ করেছেন কিন্তু কোন ফল হয়নি। তবে ওদের দাম্পত্য জীবনে সুখ নেই ঠিক কথা, কিন্তু শান্তি আছে।
পাশেই মৌমিতাদের বাড়ি। ওরা বড়লোক। গ্রামের ‘শ্রী ভারতী বিদ্যাপীঠ হাইস্কুলে’ টগর ও মৌমিতা একসাথে পড়াশুনা করেছে। পুরনো পরিচয় ছিল বলে এখন সম্পর্ক আরো গভীর হয়েছে। টগর দিনে অনেকটা সময় মৌমিতাদের বাড়িতে কাটায়। মৌমিতা আবার বাস্তুবিদ্যা চর্চা করে। তাতে নাকি মানুষের জীবনের অনেক নেগেটিভিটি কাটিয়ে পজেটিভিটি-র উত্তরন হয়। টগর যা দেখে যা শোনে বাড়িতে এসে নিজের উপর তা প্রয়োগ করে।
আজ মাঠে কাজ করতে করতে বনমালি এসে খবর দিল গোপাল সহ চার জনের কৃষিঋণ স্যাংশান হয়েছে। গোপাল খুবই চিন্তায় ছিল। এবছর চাষটা ভালোই হবে। বৃষ্টি পরিমাণ মতই হচ্ছে। গোপাল মনে মনে ছটফট করে, কখন বাড়িতে গিয়ে টগরকে ঋনের কথাটা বলবে। ভিটে মাড়াতেই গোপাল উচ্চস্বরে বলে উঠলো,”টগর একটা ভালো খবর আছে।” টগর রান্নার জোলো হাত শাড়ির আঁচলে মুছতে মুছতে গোপালকে থামিয়ে দিয়ে বলল “থাক থাক এখন বলোনা। আগে হাত পা ধোও। ঘরে এসে বসো তারপরে।” “যথা আজ্ঞা” বলে গোপাল হাত পা ধুতে চলে গেল। হাত পা ধুয়ে ঘাটের উপরে বসতেই টগর চেচিয়ে ওঠে “না না ওমন করে নয় উত্তর দিকে মুখ করে বসো। আর এই এলাচটা গালের বাম দিকে রেখে বলো কী সুখবর।” গোপালের এত বাড়াবাড়ি ভালো লাগেনা। কিন্তু ক্ষতি তো আর হয়না। তাই বউকে আর ঘাটায় না। এলাচটা মুখে দিয়ে উত্তর মুখ করে ঋণ পাওয়ার খবরটা টগরকে দেয়। টগর খুশি হয়ে কপালে হাত ঠেকিয়ে বলে “জয়মা জয়মা দেখেছো উত্তর দিক আর এলাচের কি গুন।” গোপাল বোঝানোর চেষ্টা করেনা যে খবরটা ও আগেই এনেছে। এলাচ আর উত্তরদিক পরে। শুধু মনে মনে বলে “পাগলি”। বলবে নাই বা কেন! ঘুমিয়ে পড়লে ঠেলে তুলবে শুতে গেলে নাকি দক্ষিণ বা পূর্বে মাথা দিতে হবে। ঘরের জিনিস এদিক থেকে ওদিকে সরাবে। রান্না করবে পূর্বে মুখ করে তো আলমারি রাখবে উত্তরে মুখ করে। ঠাকুরের জায়গা ঈশান কোনে তো বাথরুম পশ্চিমে আরো কত কি! গোপাল মাঝে মাঝে রেগে গিয়ে বলে, “বেঁচে গেলে শশুরের এতবড় ঘড়ের চালা বাড়িটা আছে, তাই। হতো, হতো কোলকাতার একঠুখানি জায়গা, যেখানে ভালো করে থাকাই যায়না তার উপর দিক মেনে রান্না ঘর, পায়খানা, যত্তসব!” গোপালের বন্ধু-বান্ধব ব্যাপার টা জেনে গেছে। ওরাও গোপালকে একটু আধটু টগরকে নিয়ে ব্যাঙ্গ বিদ্রুপ করে সুযোগ পেলেই।
বিকেলে পাড়ায় বাচ্চাদের সাথে টগর শিং ভেঙে বাছুর হয়ে খেলবে। ঘরে গোপাল প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এতে নাকি বাড়িতে নতুন সদস্যের আগমন হবে। “বাচ্চা গোপাল, মুর্তি গোপালদের যত্নের ত্রুটি নেই। আর আমি যে জ্যান্ত গোপালটা অযত্নে লুটোপুটি খাচ্ছি তার খেয়াল নেই।” বড়লোক বান্ধবী মৌমিতাই ওর মাথায় এসব ঢোকাচ্ছে। এমনকি ডাক্তার কবিরাজও সেই উদ্যোগ নিয়ে দেখাচ্ছে।
ইদানিং টগরকে এক নতুন রোগে ধরছে। গোপাল বাড়ি থেকে বার হলেই টগর বলে, বাড়ি ফেরার সময় কিছু নিয়ে বাড়ি ফিরবে। গোপাল ক্ষেপে গিয়ে বলে “তোমার জন্য চাল, ডাল,তেল, নুন বাচ্চাদের জন্য লজেস, গোপালের জন্য বাতাসা, নকুলদানা এসব তো এনেই দিই! তাছাড়া মাঠে কাজ করতে যাই ফেরার সময় কি আনবো? টগর একটু ভেবে বলে “একটা শুকনো কাঠ কুটো এনো, দেখো দশদিনের কাঠ একজায়গায় করলে একদিনের জ্বালানিতো হবে। না হয় কিছুটা করে ঘাস আনলে গরুটা তো খেতে পারবে। এতে ঘরে লক্ষ্মীর আগমন হয়।” গোপাল কাঁদবে না হাসবে কিছুই বুঝতে পারেনা। একটু চাপা স্বরে বলে “শুধু পাগলি? এ হলো বাস্তু পাগলি।”
সেদিন চারবন্ধু মিলে জমির কাজ সেরে পরেশ বাবুর বাগানের উপর দিয়ে সর্টকার্টে বাড়ি ফিরছিল। তখনও গোপাল টগরের জন্য কিছু নেয়নি। কারন বন্ধুরা ব্যাঙ্গ বিদ্রুপ করতে পারে। এরমধ্যে এক বন্ধু দেখে রাস্তার ধারে জঙ্গলের পাশে একটা গোসাপের অখণ্ড কঙ্কাল। সে মজা করে গোসাপের কঙ্কালটা দেখিয়ে বলে “ও গোপাল তোর বউের জন্য এটা নিবি নাকি?” গোপাল খুব ক্ষেপে যায়। কারন ঘরে বউয়ের বাস্তুনীতি আর বাইরে বন্ধু বান্ধাবদের ব্যাঙ্গপ্তি আর সহ্য হয় না। গোপাল বলে “ঠিক বলেছিস আজ এটাই টগরের জন্য নিয়ে যাব।” বন্ধুরা একটু অপ্রস্তুতে পড়ে যায়। কারন ওরা মজা করেছিল। গোপাল শুনবার পাত্র নয়। ওদের বারন না শুনে গোসাপের কঙ্কালটা নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা হয়। চুপচাপ রাস্তায় চলছে আর মনে মনে টগরকে নিয়ে অনেক কিছু বলছে। আজ সে এক প্রস্তু ঝগড়া করবেই করবে। যাতে টগরের এই ক্ষ্যাপামি বন্ধ হয়।
দুপুর গড়িয়ে বিকেলের পথে সূর্যদেব। গোপাল বাড়ি ঢুকে নিজেই চেচিয়ে বলল “এই নাও তোমার প্রয়োজনীয় জিনিস।” মনে মনে ভাবে টগর এসে দেখেই ক্ষেপে যাবে।
তখন গোপাল নিজে ততোধিক ক্ষেপে ঝগরা করবে। যাতে আর পরেরদিন থেকে “কিছু এনো” কথাটা না বলে। কিন্তু একি! টগর এসে গোসাপের কঙ্কালটা দেখে প্রথমে থতমত খেয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর একটু মুচকি হেসে বলে, “কাঠঘরে গিয়ে টাঙিয়ে রেখে এসো আর তাড়াতাড়ি স্নান করে নাও। অনেক বেলা হয়েছে। গোপাল স্তম্ভিত সে যা ভেবেছিল ঠিক তার উল্ঠোটাই হল। ওর হাসিটা যেন মনে করিয়ে দিল মাইকেল মধুসুদন দত্তের কবিতাটি–
‘যেখানে দেখিবে ছাই কুড়াইয়া দেখ তাই
পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন।’
কিন্তু টগর কেন চেচামেচি না করে শুধু মুচকি হাসল তা গোপাল বুঝে উঠতে পারলনা। গোপাল রিতিমত অবাক হয়ে টগরকে প্রশ্ন করল “তুমি আমার উপর রাগ তো করলেই না, উল্টে হাসছো! আমি তোমাকে পাচ বছরেও চিনতে পারলাম না।” টগর সেই একই হাসি মুখে রেখে তার হাসার কারন ব্যাখা করল। “দেখ, তোমাকে আমি কাঠ, ঘাস এসব কিছু আনতে বলেছি। এগুলো তুমি অনায়াসেই মাটে ঘাটে পেতে পার। হটাৎ কেনই বা তুমি গোসাপের কঙ্কালটা দেখতে পেলে? আর কেনই বা ওটা তুমি বাড়িতে নিয়ে আসবে? নিশ্চই সৃষ্টিকর্তা কোন ইঙ্গিত করেছেন। সেই জন্যই কঙ্কালটা কাঠের ঘরে ঝুলিয়ে রাখলাম। থাকনা, ভালো না হোক খারাপ তো হচ্ছেনা।” ব্যাখা শুনে গোপাল একটু হেসে বলল “খনার পূনর্জন্ম হয়ে তুমি ধরাধামে এসেছো।”
পঞ্চায়েত প্রধান পরেশ বাবুর মেয়ের এক কঠিন ব্যামো হয়েছে। বড় বড় ডাক্তার কবিরাজ সব ফেল কাঁড়ি কাঁড়ি ঔষধ ভাত রুটির মতো খাচ্ছে। কিন্তু রোগ সারছেনা। খিদে হয়না, পেটের যন্ত্রণা, দিন দিন রোগা হয়ে যাচ্ছে, শরীরের লাবন্য টুকুও নেই। বিয়ে দিতে হবে একটা মাত্র সন্তান। চিন্তায় চিন্তায় পরেশবাবু সুগার ধরে গেছে। পরেশবাবু স্ত্রীয়েরও একই দশা। চেহারা আধখানা হয়ে গেছে। বাড়ির কাজের বউ বগলা গিন্নি মাকে বলল “মা ছামদারা গ্রামে একটা ভাঙা কালীমন্দির আছে। ওখানে এক তান্ত্রিক থাকেন। তিনি অনেক কঠিন কঠিন রোগ নিমেষে সারিয়ে দেন। কর্তাবাবুকে বলে ওনাকে একবার ডাকুন না।” গিন্নিমা কথাটা শুনে একটু আশার আলো দেখলেন। কিন্তু পরেশবাবুর কানে তোলেন কি করে, উনিতো তন্ত্র মন্ত্র জড়িবুটি এসব বিশ্বাসই করেনা। তবুও মেয়ের ভালো হবে এই ভেবে বুকে সাহস নিয়ে গিন্নিমা পরেশবাবুর কাছে কথাটি পাড়লেন। শুনে প্রথমটা পরেশবাবু “বুজরুকি” বলে উড়িয়ে দিলেন। অনেক কাকুতি মিনতি করায় উনি রাজি হলেন তবে একটা শর্তে ডাক্তারি ওষুধ যেমন চলছে চলবে।
তান্ত্রিক এলেন। পরেশবাবুর মেয়েকে ভালো করে আপাদমস্তক নিরিক্ষন করলেন। তার মধ্যে আড়চোখে দেখে বুঝে ফেলেছেন, পরেশবাবু কেমন যেন সন্দেহের চোখে তাকে দেখছেন। তান্ত্রিক গিন্নিমায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন “মা, তোর স্বামী তো এসব বিশ্বাস করেন না। কিন্তু তুই মা ভৈরবীর উপর বিশ্বাস রাখ, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি কথা দিচ্ছি।” এই পযর্ন্ত শুনে বাড়ির সকলে যেন আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠল। পরেশবাবু ভাবলেন “আমি যে বিশ্বাস করছিনা এ তান্ত্রিক তা বুঝলো কি ভাবে?” পরেশবাবুর অবিশ্বাসের মরুভূমিতে যেন একটু বিশ্বাসের মেঘ জমল। গিন্নিমা বললেন, “বলুন বাবা এখন আমরা কী করব? তান্ত্রিক মাথা নীচু করে জটা চুলকিয়ে দাড়িতে বার কবার হাত বুলিয়ে চোখ বন্ধ করে বললেন “একটা দূর্লভ জিনিস যদি আমাকে জোগাড় করে এনে দিতে পারিস তো সাতদিনেই বুঝতে পারবি যে তোর মেয়ে সুস্থ হয়ে উঠেছে।” নাস্তিক পরেশ বাবুর মুখ ফসকে বেড়িয়ে গেল “কি বাবা বলুন, চেষ্টা করতে তো দোষ নেই।” তান্ত্রিক আধবোজা চোখে পরেশবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন “মায়ের উপর বিশ্বাস রাখ চেষ্টা সফল হবে।” গিন্নিমা বললেন “বলুন বাবা কি জোগাড় করতে হবে?” তান্ত্রিক বললেন “একটা অখণ্ড গোসাপের কঙ্কাল। তার ঘাড় থেকে লেজ পযর্ন্ত শিরদাড়ার বিজোড় সংখ্যা গুনে মধ্য খন্ডটি আমার প্রয়োজন।
পরেশবাবু পার্টির গোটা পঞ্চাশেক ছেলে উপস্থিত ছিল। তারা পরেশবাবুকে ভরসা দিয়ে বলল “কিছু ভাববেননা দাদা আমারা ঠিক জোগাড় করে এনে দেব।” দু-একটা গ্রামের বন-বাদাড় তন্য তন্য করে খুজে একটা মরা সাপ পাওয়া গেল বটে তবে গোসাপ কোথাও! অনেক চেষ্টায় যদিও একটা পেল কিন্তু অখণ্ড নয়। পরেশবাবু পুরষ্কার ঘোষনা করলেন। তাতেও কাজ হলনা। খবরটা একান ওকান হতে হতে গ্রাম ময়রটে যায়। এবং একসময় টগরের কানেও খবরটা পৌছায়। আমাবস্যায় টগর কঙ্কাল ছোঁবে না বলে গোপালকে দিয়ে জোর করে কঙ্কাল হাতে পরেশবাবুর বাড়ি পাঠায়।
সপ্তাহ দুই পরে গোপাল মাঠ থেকে বাড়ি এসে দেখে টগর ঘরে নেই। গোপাল বার দুই ডেকে কোন সারা না পেয়ে স্নান সেরে নেয়। এর মধ্যে টগর আনন্দে টগবগ করে ফুটতে ফুটতে একটা মিষ্টির হাড়ি হাতে ঘরে ঢোকে। গোপাল হাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে বড় হাড়ির নীচে গোটা চারেক রসোগোল্লা। গোপাল ভাবে পাগলি কি আবার ক্ষেপলো?” রেগে গিয়ে বলে “তোমার কি মাথায় দোষ আছে? খিদেয় পেঠ জ্বলছে আর তুমি…” টগর গোপালের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ওর গালে একটা রসোগোল্লা ঢুকিয়ে দিয়ে বলে “মাথায় দোষ তো ছিলনা। হলো আনন্দে।” “ঝেড়ে কাশ তো ! তোমার কথার মাথামুন্ডু আমি কিছু বুঝছিনা।” টগর হাসতে হাসতে বলল “ডাক্তার আমার ইউরিন পরীক্ষা করে পজিটিভ বলেছে।” শুনে যেন গোপালেরও আনন্দে পাগল হয়ে যাবার জোগাড়। কপালে হাত ঠেকিয়ে মা-বাবার উদ্দেশ্য বলল “মা তুমি বা বাবা কেউ একজন আমার ঘরে এসো।” সেদিন আর আনন্দে সারাদিন খেতে পযর্ন্ত পারলনা ভালভাবে। রাতে বিছানায় শুয়ে গোপাল বলল “আমার কাছেও একটা ভালো খবর আছে। প্রধানের মেয়ে এখন অনেক সুস্থ।” টগর বলল “তাহলে কাল সকালে গিয়ে একবার খোজ নিয়ে এসো। বাচ্চা মেয়ে, আস্তকাল পড়ে আছে। মা ভৈরবী ওদের ইচ্ছা পুরন করলেন।”
গল্পগুজব করতে করতে অনেক রাতে দুজনে ঘুমিয়ে পড়ল। পরের দিন আর ভোরে ওঠা হয়নি একটু বেলায় ঘুম থেকে উঠে বাসি মুখে টগর উঠোনে গোবর জল ছেটাচ্ছে। এমন সময় পরেশবাবু এসে হাজির “বউমা গোপাল কই? টগর গোপালকে ডাকার আগেই গোপাল বারান্দায় এসে “আরে কাকা! কি ব্যাপার? আসুন আসুন ঘরে আসুন” বলে ডাকল। পরেশবাবু উৎফুল্ল হয়ে বললেন “না না এখন বসবোনা, একটা কথা বলতে এলাম। আমার মেয়ে এখন অনেক ভালো আছে।” টগর কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল, “সবই মা ভৈরবীর ইচ্ছা।” পরেশবাবু আরও খুশি হয়ে বললেন “আমি শুধু এই খবরটি দিতে আসিনি। গোপাল তোকে বলছি তোর জমিটা ভাগচাষে দিয়ে দিবি। সামনের মাস থেকে আমাদের পঞ্চায়েত অফিসে যোগ দিবি।” তোকে একশ দিনের কাজের সুপার ভাইজার করব। গোপাল পরেশবাবুকে থামিয়ে, “কিন্তু…” বলল। পরেশবাবু বলল “না না তোকে রাজনীতি করতে হবে না। তোর চাকরি এমনিই পাকা।” টগর কপালে হাত দিয়ে বলে “সবই বাস্তুদেবের কৃপা।” কিন্তু এই ঘটনা শুনে নিন্দুকেরা বলে, “ঝড়ে তাল পড়ে। কাক বলে আমার বাতাসে।”
◆◇◆◇◆◇◆◇◆◇◆
◆◇◆◇◆