✍ রুম্পা দে এবং ✍ শ্যামাপ্রসাদ সরকার
লেখক পরিচিতি :-
রুম্পা দে :-
পেশায় শিক্ষিকা ও নেশায় সাহিত্যকর্মী বলেন নিজেকে। গদ্য ও পদ্যে তাঁর কলম সহজ ও সাবলীল। একনিষ্ঠ পড়ুয়া এবং সাহিত্য সমালোচক হওয়া সত্ত্বেও অবসরে নিজেও লিখতে বসেন ঘর-গৃহস্থালী সামলে।
“বকুলবাসর” ছাড়াও সহ লেখক শ্যামাপ্রসাদ সরকারের সাথে লিখেছেন ছোটগল্প
” জেনারেলি বেগম ” ও “মেঘ, বৃষ্টি ও কৃষ্ণকলি” কবিতাগুচ্ছ।
শ্যামাপ্রসাদ সরকার :-
কবিতা দিয়ে সাহিত্যের অঙ্গনে পা রাখলেও বর্তমানে গদ্য ও পদ্য রচনায় সিদ্ধহস্ত এবং পাঠকমহলে বেশ সমাদৃত। বেশ কটি একক উপন্যাস ও গল্পসংগ্রহ ইতিমধ্যে প্রকাশিত ও সমাদৃত। কবিতার জন্যে
বিবর্তন সাহিত্য সম্মাননা ও গল্পগুচ্ছের জন্য মণিরত্নম সাহিত্য পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন সম্প্রতি।
“বকুল বাসর”
*************
( কাহিনীকার –
রুম্পা দে এবং শ্যামাপ্রসাদ সরকার)
(১)
***********
“আলগা করগো খোঁপার বাঁধন /দিল মেরা ওহি ফাঁস গ্যয়ি”- গুন গুন সুরে গান টা এখনো কানে ভাসছিল মিষ্টুর ।একটু আনমনা সে ।বারে বারে ভুল হয়ে যাচ্ছে প্লেট গুলো সাজাতে ।সেটা নজর এড়ায়না শতাব্দীর ।ভাগ্নী কে সপ্রশ্রয় একটা ঠেলা মেরে উঠে যান বরযাত্রীদের আপ্যায়নে।আজ ঋতজার বিয়ে ।ঋতজা এবাড়ির বড়ো মেয়ে, শতাব্দীর ভাসুরঝি আর মিষ্টুর মামাতো দিদি ।সুদূর হাজারিবাগ থেকে আসা বলে বর এবং বরযাত্রী এসে গেছে বিয়ের আগের দিনই ।তাই সারা বাড়ি জুড়ে চতুর্গুণ ব্যস্ততা ।
সকাল থেকে একনাগাড়ে বৃষ্টি এমনিই মেজাজ টা তিরিক্ষি করে তুলেছিল মিষ্টুর ।তারপর যখন শুনল বরযাত্রীদের ভাড়াবাড়িতে আনাগোনা করে তাদের দেখভাল করার দায়িত্ব তার, তখন আর মেজাজ ঠিক রাখা গেল না ।মায়ের সাথে একচোট খণ্ড যুদ্ধ হয়েই গেল ।কেন যে এমন হয়, মিষ্টু নিজেও বোঝেনা, কেবলি মনে হয় তাদের আর্থিক দুর্বলতার জন্যই বুঝি এই বেগার খাটা ।আজ বাপি থাকলে কেউ নিশ্চয়ই তাদের এভাবে সবসময়ই গায়ে গতরে খাটিয়ে নিত না ।মা যে কেন বুঝতে চায়না! কিম্বা সত্যি ই হয়তো মায়ের বোঝার উপায় নেই ।
একটা বেসরকারী বিমা সংস্থার ব্যাক অফিসে কাজ করার সামান্য কিছু পারিশ্রমিক আর টুকটাক সূচী শিল্প মিলিয়ে যে কটা টাকা তার মাসের শেষে রোজগার তাতে করে এতদিনের এই লজঝড়ে সংসারের ফুটোফাটাগুলো ঢেকে আর সম্ভ্রান্ত জীবন যাপনের চৌকাঠ পেরোনো যায়না।তাই মামারবাড়ির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেই হয় ইচ্ছে -অনিচ্ছের সিন্দুকে চাবি দিয়ে ।অবশ্য মিষ্টুর এই বনেদী মামারা কখনো দুর্ব্যবহার করেছে তাদের সাথে এমনটাও বলা যাবে না ।তাঁরা বরং একটু বেশী ই সহৃদয় ওদের প্রতি ।তবুও একমাত্র ছোটোমামী শতাব্দীকে বাদ দিলে কারো সহৃদয়তাই ততটা বেমানান বলে মনে হয়না মিষ্টুর। ওর সবটাই খুব লোকদেখানো মনে হয়। খুবই সুন্দরী হয়েও কোথাও একটা নির্লিপ্তি নিয়ে ও সংসার করে। কে জানে হয়তো শতাব্দী ওকে অপয়া বা পোড়াকপালীই ভেবেই এমনটা মনে করে; নাকি হীনমন্যতা আর বঞ্চিত জীবনের দুঃখ বিলাস মিষ্টুর অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে আজকাল!
তবে শুরু টা যতটা বিরক্তির সাথে হয়েছিল, নিকুঞ্জ ভিলার এই প্রবাসী বাঙালি দলটির আতিথেয়তার কাজটা পরে আর ততটা বিরক্ত করছিল না ।আসলে অপরিচিত থেকে পরিচিত হয়ে ওঠার পথটা একটা বন্য সুগন্ধে ভরা থাকে ।যে ফুল দিয়ে ঘর ও সাজানো যায়না আবার অজানা বলে না তাকিয়ে উপেক্ষা ও করা যায়না। এই মানুষগুলোর অর্ধ অভ্যস্ত বাঙালীয়ানা, ঘন ঘন অবাক হওয়ার অভ্যাস অন্যতর জীবন যাপন ও দৃষ্টিভঙ্গী মিষ্টুকে বেশ টানছিল ।বিশেষত ওই বাসব নামের যে ছেলেটা, ভীষণ রকমের সপ্রতিভতায় মিষ্টুর মনখারাপ গুলো কে কোথায় যেন ভাসিয়ে দিল। সম্পর্কে ও নাকি ঋতজার দেওর।তাই মিষ্টুর দিকে নজর রাখা ওর সাংবিধানিক অধিকার -এমনটাই ঘোষণা করেছিল প্রথম পরিচয়েই ।
একটা নাছোড় দ্বিচারিতার অনুভূতি তবু পিছু ছাড়ছে না মিষ্টুর ।আলগা করগো খোঁপার বাঁধন -এই গানটাই প্রথম শুনিয়েছিল রূপম ওকে দেখে ফিরে যাবার পর রাতের ফোনালাপে ।গরীব বিধবার জন্মাবধি রুগ্ন মেয়েটাকে ও যে কারো পছন্দ হতে পারে, এটা কিছুতেই সেদিন মা-মেয়ের বিশ্বাস হয়নি। কোমর ছাপানো একঢাল কালো চুল আর তন্ময় গভীর দুটো চোখই নাকি সেদিন বিবশ করেছিল কর্পোরেট রূপমকে ।তারপরের তিনটে মাস মাঝনদীতে ময়ূরপঙ্খী নাও হয়ে তারা ভেসে ছিল। কত কিছুই যে মনে আসছে একে একে বাসবের হাসি, কথার পিঠে কথা আর গানের সাথে সাথে ।
হাত পাগুলো ব্যথা করছে, মাথাটাও ভার মনে হচ্ছে, একটু শীত শীত ও করছে যেন । তবে কি ঠাণ্ডা লেগে গেল জোলো হাওয়ায় বেসামাল হয়ে? ডাক্তারের কড়া নির্দেশ ঠান্ডা লাগানো যাবে না, চড়া গন্ধের সংস্পর্শে থাকা যাবে না ।তবে কি ..? যাকগে বিয়েবাড়িতেও এমন আরোপিত বৈধব্য আর শুদ্ধাচারের ছুৎমার্গ নিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে না মিষ্টুর ।কটা দিন যাক ।তারপর সব আবার আগের মতো করে নেবে ।রূপম কি রাগ করবে তার এই বাচালতায়! বাসব যদি জানতে পারে তার ক্ষয়ে আসা ভবিষ্যতের কথা, এমন থাকবে তার চপলতা!
ইসস্! কত্ত দেরী হয়ে গেল। ছোটো মামী রাগ করবে খুব ।তাড়াতাড়ি উঠে পড়তে গেল মিষ্টু, প্লেট গুলো পৌঁছে দিতে হবে ।মাথাটা টলছে কেন এমন? বুকটা এত চাপ লাগছে যে দমবন্ধ হয়ে আসছে ।মা কে ডাকতে গেল মিষ্টু ।কিন্তু কে যেন চেপে ধরেছে গলাটা ।আবার এই সময়ে এত ঘুম পাচ্ছে !চোখ দুটো বুজে আসছে যে ।ওই যে ঋতুদি কাদের নিয়ে ছুটে আসছে, বলছে মিষ্টুর তো একটা ভালব ডিফেক্টেড, ও এত চাপ নিতে পারেনা।
দরজার বাইরে কে দাঁড়িয়ে? রূপম না? হ্যাঁ ওই তো মাথায় টোপর, গলায় মালা আর ডান কানে র পাশ দিয়ে কত রক্ত !মিষ্টু যাবে রূপমের কাছে ।অ্যাক্সিডেণ্টের পর এই প্রথম এল রূপম ।কিন্তু বাসব, বাসব কেন দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে ? নাঃ আর পারছেনা মিষ্টু চোখ চেয়ে থাকতে ।বড়ো ঘুম পাচ্ছে, নিঃশ্বাস ফুরিয়ে যাচ্ছেযেন, আর ক্রমশ বুজে যাচ্ছে চোখ দুটো ।
একটা বরযাত্রীর বাস হইহই করে বেরিয়ে গেল। বরের গাড়িটা এখন পিছনে আসছে। রূপম আজ খুব টেনশনে ! বিয়ে করতে গেলে এত বুক ধড়ফড় করে না কি? দামী তসরের পাঞ্জাবীর তলায় ঘামের স্রোত বয়ে চলছে। ঠিক জয়েন্ট পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোনোর দিনের মত লাগছে যেন। সঙ্গে রাঙাপিসেমশায় আর টুটুনদির ছেলে রন্টুও একসাথে ওই এক গাড়িতে। টুটুনদি মানে রাঙাপিসেমশায়ের মেয়ে, ওরা, নীতিশদা আর সবাই ওই বরযাত্রীর বাসটাতে আছে। সাতবছরের রন্টুই ওর নীতবর সেজেছে। সুন্দর লাগছে পুঁচকে রন্টুকে চন্দন রঙের এই পাঞ্জাবী পাজামার সেটটাতে আজ। মিষ্টুকে আজ ঘনকালো হরিণ চোখে কেমন দেখাচ্ছে? ওর চোখের পাতাগুলো বেশ বড় বড়। একটা ছায়া দেওয়ার নির্ভরতা আছে তাতে। মা বেটার ছন্নছাড়া জীবনে একটা মানুষ যোগ হতে যাচ্ছে, ও পারবে তো সবাইকে সুখে রাখতে?
রাঙাপিসেমশায় মানুষটাও খুবই আমুদে। বাবা তো সেই ক্লাস সিক্সেই চলে গেল। রাঙাপিসিরা তখন সাহায্য না করলে এত দূর লেখাপড়া করতেই পারতো না রূপম সুন্দরপুর বয়েজ স্কুলের হেডমাস্টার রাঙাপিসেমশায় ওর বাবার অভাব অনেকটাই পূরণ করে এসছেন চিরদিন।
হাইওয়েটা ছাড়িয়ে একটা নয়ানজুলির মোড় পড়ে, সেটা ছাড়িয়ে আর একটু বাঁদিকে গেলে সূর্যসেন নগরের সাইনবোর্ডটা স্পষ্ট দেখা যায়। তারপর আর আধঘন্টা মত লাগার কথা। শহরতলির এই অংশগুলো ক’বছর আগেও গ্রাম গ্রাম ছিল এখন আর তা বোঝার জো নেই। নয়ানজুলিটার কাছে পৌঁছনোর আগেই একটা দৈত্যাকার কন্টেনার ট্রাক, খুউউব জোরালো আলো আর ভীষণ স্পিডে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে ওদের গাড়ির কাছাকাছি চলে আসছে, ওদের ড্রাইভার গালাগালি দিয়ে হর্ন দিচ্ছে, কিন্তু নাহ! অত্তবড় হেডলাইটগুলো আরো কাছে আরো কাছে ক্রমশ এগিয়ে আসছে..তীব্র ঝাঁকুনি আর খুব জোরের সঙ্গে হুড়মুড় করে সেটা ওদের গাড়িটাকে…..থকথকে কালচে রক্ত ততক্ষণে ডালপালা মেলে ছড়িয়ে পড়েছে নদী হয়ে। ওলোটপালট হয়ে যাওয়া একটা সংঘর্ষের পরিণামে তসরের পাঞ্জাবী আর তার সঙ্গে থাকা তরতাজা প্রাণগুলো মৃতদেহ হয়েই পিচঢালা রাস্তার ওপর থেঁৎলে পড়ে থাকে। সূর্যসেননগরের বিয়ের আসরে তখনো সানাই এ সিন্ধু বারোঁয়ায় তানকারি করে গৎ মেলাচ্ছেন বিসমিল্লা খান।
(২)
***********
মিষ্টু চোখ খুলতেই একদলা ভীড়, নাকে আসছিল দামী সুগন্ধীর চলকে পড়া গুমোট গন্ধ আর ঝাপসা ঝাপসা কিছু মুখ দেখতে পাচ্ছে। কোথায় এখন ও ! মা ! মা ! গলা থেকে আওয়াজ বেরোল না মোটেও। বড়মামীমার বোন রিক্তামাসি একটা গ্লাসে জল এগিয়ে দিচ্ছে কেন? সবকিছু আবার স্বাভাবিক ছন্দে ফিরিয়ে আনার জন্য কিছুক্ষণের জন্য চোখদুটো বুজল মিষ্টু।
” কি যে দরকার বাবা ! এসব রুগী টুগী এনে ঝঞ্ঝাট পাকানোর? কাজের বাড়ি এখুনি বরযাত্রীরা ও বাড়ি থেকে এসে পড়বে ! তা নয় আদিখ্যেতা করে করেই সব গেল !” খরস্বরে গজগজ করতে থাকে শতাব্দী।
বিয়ে শেষ করে বাসর বসতে বেশ দেরী হয়ে গেল। তবুও বাসরের একটা নির্দোষ টান আছে। পাত্র পাত্রী ছাড়াও অন্যদের কাছে একটা আলগা উত্তেজনা, সেটা নিছক আনন্দেরই বোধহয়,এসে জমাট বাঁধে। রূপবান জামাই আর তার কয়েকজন বন্ধু আর একজন ভাই এরাই সব ওপক্ষের। এদিকে কয়েকজন সদ্যবিবাহিতা, মধ্যবয়সিনী আর অবিবাহিতা কিছু ফুরফুরে গোলাপীরঙের বৃন্দাদূতীরা মিলে বাসরের আসর জমিয়ে তুলছে।
‘কার মিলন চাও বিরহী..তাহারে কোথা খুঁজিছ..’ কি স্পষ্ট উচ্চারণে দক্ষিণীর একদা ছাত্রী ঋতজা গানটি গেয়ে ষড়ঐশ্বর্যের একটি একটি করে পর্দা মেলায় অবলীলায়। শতাব্দী অবশ্য এখানে শ্রোতাই, সুর তার গলায় বসে না, বরং হাল্কা আদিরসের পুষ্পবাণ সে তূণীর ভরে এনেছে। মাত্র দুবছর আগে সে এ বাড়িতে পা রেখেছে পঞ্চশরের সবকটি এখনো তার অটুট। খোঁপার মালাটা ঠিক করার অছিলায় আঁচলটা সামান্য সরে গেল তার।
বাসব চুপ করে দেখছিল ঘন দীঘল চোখের মেয়েটিকে। সন্ধ্যেবেলায় সে নাকি একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছিল? কিসের অসুখ? মেয়েটির জীবনের গহীনে কোথাও একটা ক্লান্তির ভার রয়েছে সেটা বোঝাই যায় অনুভবে। ওর ওই চোখগুলোই সেটা বলে দেয়। এরকম সহজ সত্যি চোখের সামনে সোজাসুজি বেশীক্ষণ চেয়ে থাকা যায়না, বড় অকপট গভীর ওই দৃষ্টি।ওকে দেখলে পূর্বজন্মের চেনা মনে হয় বারবার !
বাসব অনেক ভেবেচিন্তে কোলবালিশে চাপড় দিয়ে ধরলো, ‘বঁধু তোমার আমার এই যে বিরহ এক জনমের নহে…’
গানের সুর আর আলগা হাসিঠাট্টা ঘুরপাক খায় অনেক্ষণ বাসরের জানলার শার্সি জুড়ে। ফুলের মালায় যদিও ততোক্ষণে হলদেটে রঙের ছোপ ধরেছে।
একটু একটু করে মিষ্টুর বুকের মধ্যে পাপড়িগুলো মেলে উঠতেই কেন যে বন্ধ হয়ে যায় বারবার? সবাইকে তখন অপ্রস্তুত করে দিয়ে নিজেকে বড্ড ছোট লাগছিল। একটা আনন্দের দিনে, ছি ছি! কি লজ্জা !
রূপম তো আর কোনওদিন ফিরে আসবে না ওর থমকে যাওয়া বাসর জাগাতে। সারাজীবন সধবা আর বিধবার দোলাচলেই দুলতে হবে ওকে। বিয়ের আসরে পৌঁছনোর আগেই যার বর মরে যায় সে তো সর্বনাশী! বুকের অসুখটা কি ছুটির ঘন্টা বাজাবে না কোনওদিন?
তবুও অন্ততঃ একবার সাধ হয় জীবনকে সাপটে,জাপটে জড়িয়ে চেখে দেখার। বন্ধ হয়ে যাওয়া সানাইটা ভিতরে ভিতরে কেদারে ফুকরে ওঠে। এরকম করে রোজই আজকাল একবার করে মরতে হয় তাকে, জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে যেতে যেতে একটা মুখ যেন আবার দেখতে পাচ্ছিল বরবেশে! রূপম তো নয় সে! কে তবে? কে?
বাসররাতের শেষযামে মিষ্টু সকল কাঁটা ধন্য করে গেয়ে ওঠে,
“দীপ নিভে গেছে মম নিশীথ সমীরে…”
কিছু মানুষের প্রথাগত শিক্ষার বাইরে থাকে এক সহজাত শিক্ষা, যা অন্তরের আলোয় তাকে উদ্ভাসিত করে । মিষ্টুরও এমনটাই বলা চলে ।প্রথম কৈশোরেই পিতৃহারা মেয়েটির শিক্ষা আর চিকিৎসার ধকল সামলাতেই তনুজার মাথা বিকিয়েছে ভ্রাতৃগৃহে।সখের হিসেবনিকেশ মেলাবার তাই সুযোগ হয়নি কখনো । তবুও শুধু জন্মসূত্রেই ঐশ্বরিক কণ্ঠের অধিকারিণী মিষ্টুর গলায় সুরের আলপনা মুগ্ধ করত অতি অজ্ঞ থেকে অতি বিজ্ঞ জনকেও। আজও সুর আর বাণী মিলে যে ভীষণ হৃদয় নিঙড়ানো আচ্ছন্নতা সৃষ্টি করল, অতি বড়ো বস্তবাদীও তার আবেদন অগ্রাহ্য করতে বুঝি পারতনা ।
বাসব সহ পুরো বরযাত্রীদলের স্তব্ধবাক সপ্রশংস দৃষ্টি কি গভীরে অন্য কোনো সুরের ঝংকার তুলে গেল? হঠাৎই যেন আরক্ত হল গালদুটি।চোখের দৃষ্টি আর সোজা পথে চলেনা, কেবলি মাটির ওপর খুঁজে বেড়ায় কোন মহার্ঘ্য বস্তু ।খানিক নীরবতার পর বাসবের গলায়এলেন জন ডান- “For God ‘s sake hold your tongue and let me love”। .আর মিষ্টুর ভাষণে সেই নিবারণ চক্রবর্তী- ” দোহাই তোদের, একটুকু চুপ কর্।
ভালোবাসিবারে দে আমারে অবসর”
নিয়তি নামক সর্বব্যাপী সেই অস্তিত্ব ঠিক কি যে ভাবছিল সেই বাসর রাতে সেই জানে, তবে অপরাপর গোলাপবালারা এই একমুখী মুগ্ধতার চাপে নজর কাড়তে নবরসের প্রথমটিতেই মনোনিবেশ করছিল বেশী । শতাব্দীর ক্লান্তি ভাঙা আড়মোড়া নিঃসন্দেহে দর্শন সুখের যোগান দেয় । তবুও সামান্য, শ্যামাঙ্গী মেয়েটিই থেকেই যায় চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে ।
রাত কেটে যখন ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে, নবদম্পতির চারচোখে যখন স্বপ্নের স্বর্ণচরীর বুনন, তখনই কিন্তু আরো একজোড়া হৃদয়ে নীরবে বেজে চলেছে বিসর্জনের সুর -রয়ে যাবার, সয়ে যাবার আর কোনো অজুহাত রইল না যে।
বরকনে বিদায়ের ব্যস্ততায় যখন সারা বাড়ি সরগরম, বিষন্ন তনুজার চোখের কোণে কয়েকটা জলের ফোঁটা দেখা দিয়েই হারিয়ে গেল অমঙ্গলের ভয়ে ।এমন একটা দিন তার জীবনে আর কখনো দেখা হবেনা ।বড়ো সাধ ছিল দুজনের মালা চন্দন আর রাঙা চেলিতে সাজানো মিষ্টুর বিদায় বেলার ছবিখানা থাকবে তার ভাঙা ঘর আলো করে । তো সাধের সে শরিক রণে ভঙ্গ দিয়েছে কোন কালেই, আর সাধনার কালও বুঝি ফুরোলো এবার ।
রাত এখন গভীর। নিশুত রাতের মায়া নেচে নেচে ঘুরছে অন্ধকার তামসী রাক্ষসী হয়ে। তনুজা এখন মেয়ের পাশেই শোয়। আজকাল মেয়েকে চোখে হারানোটা আতংকের হয়ে উঠছে ক্রমশ। মিষ্টুর চিকিৎসার জন্য অনেক অর্থেরই প্রয়োজন সঙ্গে লোকবলও। দাদাদের বদান্যতায় সে টাকাটা যদিও জোগাড় হয়েছে কোনওমতে কিন্তু তাও আরোগ্যের সম্ভাবনার নিশ্চয়তা কোথায়? অপারেশনের টেবিলেই যদি.. তনুজা উদ্গত কান্নাকে গিলে ফেলতে চায়, কিন্তু পারেনা। বালিশের কোণ নীরব অক্ষম অশ্রুর ধারায় সিক্ত হয়েই ওঠে।
মিষ্টুর চোখের ওপর এখন টুপটাপ তারা নেমে আসছে যেন অতিদূর গহীন অন্ধকারমাখা আকাশের চাদর থেকে। ছোট্ট ছোট্ট এক একটি আলোকবিন্দু স্ফটিকের মত নাকি জোনাকি? মনে আছে ছোটবেলায় বাপি ওর ছোট্ট ছোট্ট হাতের ওপর জোনাকি ধরে বসিয়ে দিত।মিষ্টু খুব মজা পেত। আর ভালবাসত প্রজাপতির ওড়া দেখতে। ছোটবেলায় কোনো দামী পুতুল বা খেলনা নয় ওর প্রিয় ছিল একটা বাদামি রঙের বাচ্চা কাঠবিড়ালী। রোজ সকালে দুচারটে মুড়ির লোভে সে আসত একসময়।
হঠাৎ একটা সুগন্ধ যেন উড়ে এল নাকে , খুব মিষ্টি মনে হল..না না..এটা সেই ধূপের গন্ধটা..রূপম কে শেষবারের মত নিয়ে যাওয়ার সময় ওর চেপে রাখা কান্নার মত পাক খেয়ে খেয়ে ওরই ধোঁয়াগুলো মিশে যাচ্ছিল চিরকালের সর্বনাশী ভাগ্যের সঙ্গে। রূউউউউপঅঅঅমমম! বলে ডাকতে ইচ্ছে করছে খুব, একটা শিরশিরে ঠান্ডা যেন কোত্থেকে এসে যেন আচ্ছন্ন করে নামতে চাইছে শিরদাঁড়া থেকে শরীরের নীচের দিকে। মিষ্টু আড়চোখে দেখে তার মা এখন ঘুমোচ্ছে। কি ক্লান্তি আর পরাজয়ের গ্লানি যেন মা এর সারাটা মুখ জুড়ে। সারাজীবন মানুষটাকে একাই লড়ে যেতে হল। ও অনেক চেষ্টা করেও মা এর যোগ্য ভরসা হয়ে উঠতে পারল কোথায়! চুপিসারে একবার জানালার সামনে এসে দাঁড়ায় সে। একটা জনহীন শূন্য পথ তার সামনে। অনির্দিষ্ট তার গন্তব্য, পরিণামহীন তার ভবিতব্য। জানালার গরাদে মুখ চেপে কি যে দেখছে মিষ্টু তার আজ হিসেব নেই । পাশাপাশি বাড়িগুলোর ছাত টপকে খোলা মাঠের কিনারে ওই জলার পাশ দিয়ে হেঁটে যায় চোখ জোড়া সূর্য নগরের সীমানা বরাবর। কালো জমাট বাঁধা রক্তের দাগ ধরা রাস্তাটার পাশে একটা বকুলের গাছ দাঁড়িয়ে আছে। গাছটা আগেও কি ছিল এখানে? আশ্চর্য! গাছটায় একটাও ফুল নেই কিন্তু মাটিটা ফুলের আচ্ছাদনে ঢাকা! বকুলগন্ধী বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে এক বরবেশী অস্পষ্ট অবয়ব চাইলেও যার মুখটা কিছুতেই রূপমের সাথে মেলানো যাচ্ছে না। হলদে হয়ে যাওয়া ফুলের জলসার আমোদ এড়িয়ে ডেটল-ওষুধ-রক্ত-বোরিক পাউডার মেশানো একটা ঝাঁঝালো গন্ধ ঘ্রাণেন্দ্রিয়ে ধাক্কা মেরে যাচ্ছে মাঝে মাঝে।স্মৃতির পাতার প্রতিটা সোনাঝরা সন্ধ্যার ছবি কেমন যেন বদলে যাচ্ছে এক অচেনা মুখের উজ্জ্বল উপস্থিতিতে ।বকুল গাছটার সব পাতা কখন ঝরে গেছে অগোচরে ।ডালপালা সর্বস্ব গাছটায় ইতস্তত ঝুলে আছে স্টেথো, নিডল, স্যালাইন বোতল, ইসিজি মেশিন, মনিটর, অজস্র চেষ্ট রিপোর্ট আর কাঁড়ি কাঁড়ি ঘুমের ওষুধ। আবারো ক্লান্তি নামে চোখে, একটা শিরশিরে অনুভূতি নেমে আসে শিরদাঁড়া বেয়ে ।অবশ লাগে শরীর। মিষ্টুর বড়ো ইচ্ছা করে বাঁচতে।
*****০০ সমাপ্ত ০০*****