“মধুরেণ”
*********
–:: শ্যামাপ্রসাদ সরকার ::–
রোববারের সকালে জলখাবারে লুচি নেই !
কুরুক্ষেত্র বাঁধতে বাকী থাকে শুধু। মালতীর মা চিনি ছাড়া লাল চা আর দুটো ব্রাউন ব্রেডের মাখনহীন নির্জীব টোস্ট নামিয়ে রেখে চলে যেতে যেতে বলে ‘বৈদি এডাই দিতি বলিছে!’ সর্বনাশের মাথায় পা ! পদে থাকলে কোর্টমার্শাল করতেন কর্নেল দত্ত!
কর্নেলগিন্নী এখন লাফিংক্লাবে। দশটা আধবুড়োবুড়ি খোলা আকাশের নীচে কি বিশ্রী মুখভঙ্গিতে ভ্যাংচায়, তার নাম আবার লাফিংক্লাব ! ফুঃ!
কানে যেন মার্চপাস্টের বিউগল্ বেজে ওঠে।
এই জন্যই জাতটার কিচ্ছু হলনা।
সামান্য লুচি ছোলার ডাল যারা ভয়ে খেতে দিতে পারেনা তারা কখনো কনকারার হয় না।
পুত্রটিও মা মার্কা। ব্যাঙ্গালোরে তার আইটি’র চাকরি ! দিন রাত কফি আর বার্গার গিলছে ! ছ্যাঃ!
আহা ! কি সব দিন ছিল ! মস্ত উনুনে গণেশমামার বিয়েতে নিতাইঠাকুর ডুমো ডুমো ফুলকো লুচি ভেজে তুলছে কাঠের বারকোশে আর বাচ্চাদের দলে তিনিও লুব্ধদৃষ্টিতে অপেক্ষা করছেন কলাপাতায় সেগুলো নেচে নেচে আসার জন্য। এবাড়িতে লুচি হচ্ছে বলে ও বাড়ির বাসু , রতনের পিঠে চড়ে এসে পড়ল। তারপর বাগানের বাতাবিলেবু পেড়ে ফুটবল খেলা ! দীর্ঘশ্বাস পড়ে দত্তবাবুর।
সুগারলেভেল চারশো। প্রেসার যেন স্টক এক্সচেঞ্জ ! রোজ চড়ছে। বুকে হাল্কা চাপ চাপ লাগে। নগেন ডাক্তার বলে মর্নিং ওয়াকে যেতে। দূর, চারটে গরম গরম লুচি আর ছোলার ডাল না খেতে পেলে আর সে জীবনের দাম কি !
কি করে এতবছর আর্মির লাইফ কাটালেন এও এক রহস্য। একাত্তরে বাংলাদেশ যুদ্ধে পদকও পেয়েছেন। মুজিবের সাথে বসে একথালায় রুটি আর বরবটি ভাজাও খেয়েছেন ! সে সব এক অন্য জন্মের গপ্পো।
মালতীর মা ঝমঝমিয়ে বাসন মেজে চলে গেল। ব্যাস এবার সোজা ফ্রন্টে তিনি। দু তিনটে পাত্র বাতিল করে ময়দা মাখলেন কোনওমতে। খুঁজে পেতে চাকা চাকা করে কাটলেন বেগুন। এইবার ক্লাইম্যাক্স। ভারতের ম্যাপ আর অষ্ট্রেলিয়ার ম্যাপের কাছাকাছি আটটা লুচি বানিয়ে যখন ঘর্মাক্ত কলেবরে উঠলেন, ঠিক তখনই ডোরবেল ! এই রে !
দত্তগিন্নীকে দেখে আর কথা সরে না তাঁর।
একী দেখছেন ! পাটভাঙা গরদের শাড়ি আর এত্তবড় লাল টিপ ! দু-একগাছা রূপোলী চুলেও দুগ্গা ঠাকুরের মতো রূপে দিব্যি খোলতাই হয়েছে। এতো লাফিংক্লাবের ড্রেস নয় ! মনে হচ্ছে কালীবাড়ি গেছিলেন স্বয়ং মহামায়াই।
ধরণী দ্বিধা হও ! অবস্হা হয় দত্তসাহেবের। গিন্নীর গলায় অকাল বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ !
‘একী রান্নাঘরে তুমি কি কচ্চিলে..এ্যাঁ !
নেতিয়ে যাওয়া লুচি দুখানা হাতে ঝুলিয়ে কর্নেল দত্ত একদম কান এঁটো করা হাসি হেসে বলেন,’ আজ কত তারিখ মনে আছে? আজ না বারোই বৈশাখ?’
স্বামীর মুখে বারোই বৈশাখ শুনে গিন্নীর মুখে হাইভোল্টেজ আলো জ্বলে ওঠে। তিরিশ বছর আগের রাঙা বৌ এর মতো বলে ওঠেন ‘যাঃ’। তারপর আঁচলের আড়াল থেকে পান্তুয়ার হাঁড়িটা বাড়িয়ে ধরেন স্বামীর দিকে।
লুচি বেগুনভাজা আর পান্তুয়া সহযোগে জলখাবার গড়িয়ে প্রায় লাঞ্চটাইম।
গরদের শাড়িটা আজই লন্ড্রীতে ধুতে দিতে হবে, পান্তুয়া খেতে গিয়ে বেআক্কেলের মত রস ফেলেছে লোভী বেড়ালটা। এত বয়সেও ঠিকমত রসের খাবারটাও রস না ফেলে খেতে শিখল না ! ধেবড়ে যাওয়া সিঁদূরে মাখামাখি লাল হয়ে যাওয়া মুখটায় ভালো করে জলের ঝাপটা দিতে দিতে ভাবলেন সলজ্জ দত্তগিন্নী।
¤●¤●¤●¤●¤●¤●¤