“বিভীষিকার সেই রাত
(সত্যি ঘটনা অবলম্বনে)”
–:: পল্লব দাস ::–
সবে মাত্র লেখাপড়া শেষ করেছি। যদি একটা কাজ পাওয়া যেত খুব ভালো হত এই আশায় বসে রইলাম। অবশ্য বেশি দিন আমাকে আপেক্ষা করে থাকতে হয়নি। অবশেষে প্রতীক্ষার সমাপ্তি ঘটলো। ডাক আসলো সুদূর শিলং থেকে। জীবনের প্রথম চাকরি তাও আবার অতো দূরে! যেতে যে আমায় হবেই কারন বাড়ির আর্থিক পরিস্থিতি সেই সময় কোন কারন বশত হঠাৎ দুর্বল হয়ে পড়েছিলো। অগত্যা শিলং যাওয়ার জন্য আমি তৈরি হলাম। হাওড়া স্টেশন থেকে সরাইঘাট এক্সপ্রেসে চেপে বসলাম। ট্রেন গিয়ে থামলো গৌহাটি স্টেশনে। সেখান থেকে গাড়ি করে শিলং। যখন পৌছালাম প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। অনেক কষ্টে অফিসে গিয়ে সবার সঙ্গে পরিচয় করে, কোম্পানির এক সহকর্মীর ভাড়া বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। শরীর ক্লান্ত বাড়ির কাছে আসতেই চমকে উঠলাম একটা কাঠের বাড়ি। আস্তে আস্তে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলাম। বাড়িতে দুটো রুম। আমাকে পিছনের রুমটা দিলো। আর সহকর্মীটি সামনের রুমটা নিলো। রাতে সামান্য কিছু খেয়ে নিলাম। হারকাপানো প্রচণ্ড ঠান্ডা আর আমার ক্লান্ত শরীর আমায় অর্ধমৃতপ্রায় করে দিয়েছিলো। পরের দিন অফিস সেরে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরলাম। কিন্তু সমস্যা হল কিছুক্ষণ পরে আমার সহকর্মী আমাকে ফোন করে বলল সে আজ বাড়ি ফিরবে না। তাকে অফিসের কাজে বাইরে যেতে হবে। অগত্যা রাতের খাবার বানিয়ে নিলাম তারাতাড়ি। খাবার খেয়ে নিলাম তাড়াতাড়ি। কারন শিলংয়ে নাকি রাত বারোটার পর লোডশেডিং হয়ে যায়। প্রচণ্ড ঠান্ডায় গরম জামাকাপড় কিছুই যেন মানছে না। এমন কাঁপুনি আসছে মনে হচ্ছে শরীরের ভেতরটা যেনো বরফ হয়ে যাচ্ছে। রাত বাড়তে লাগলো। আমি নিজের রুমে একা বসে আছি। সামনের রুমটা ফাঁকা। অতঃপর রাত বারোটা বাজতেই কারেন্টে চলে গেলো। কোন রকমে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে বসলাম। কেমন যেন মনের মধ্যে একটা ভয়ের সঞ্চার হতে লাগলো। আসলে নিজের বাড়ি থেকে এত দূরে এভাবে আমায় কখনো একা থাকতে হবে ভাবিনি। ভাবতে ভাবতেই বোধহয় আমি একটু তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হয়েছিলাম। হঠাৎ হালকা কিছুর আওয়াজে তন্দ্রা কেটে গেল। দেখলাম চারিদিকে অন্ধকার। কটা বাজে জানি না। মোমবাতির আলোটা নিভে গেছে। আমি ঘরের মধ্যে একা বসে আছি। কিছু একটা অনুভব করতে লাগলাম কেউ যেন আমার পাশের রুমে কাঠের মেঝেতে হেটে বেরাচ্ছে। স্পষ্ট পায়ের শব্দ। ঘরে আলো নেই যে দেখবো আওয়াজটা কিসের! আস্তে আস্তে প্রখর হতে লাগলো সেই শব্দ। আমার শরীর এই তীব্র ঠাণ্ডাতেও ঘামতে লাগলো! কি ওটা? কিসের আওয়াজ? একটা সময় মনে হলো আজই বুঝি আমার শেষ রাত। ঘরের মধ্যে অন্ধকারে দুটো চোখ স্পষ্ট দেখতে পেলাম। এক পলকের জন্য মনে হল কোন জ্বলন্ত আগুনের দুটো গোলা, আমার জন্য অপেক্ষা করছে। কি ওটা? তবে কি কোন…? বেশিক্ষণ ভাববারও সময় দিলো না আমাকে। কিছু একটা করতেই হবে। কি করি? সাহসও পাচ্ছি না, যে কাছে গিয়ে দেখবো। হঠাৎ ঘরের দরজার পর্দাটা উড়তে লাগলো। সমস্ত কিছু বন্ধ তাহলে এটা কি করে সম্ভব? আমার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। ভাবলাম চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করি “কে ওখানে? কে?” কিন্তু আমার গলা যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে! গলা দিয়ে কোনো শব্দ বেরোলো না। চোখ দুটো তখন স্থির হয়ে গেছে। একটু পরে অনুভব করলাম একটা পচা গন্ধ ভেসে আসছে। মনে হল আমার জন্য কারা যেন অপেক্ষা করছে। না কিছু একটা করতেই হবে! করতেই হবে আমাকে। রাত তখন মনেহয় গভীর। অনেক কষ্টে সামনের ঘরের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। না পারছি না। পা যেন শ্লথ হয়ে গেছে। তবুও চেষ্টা করলাম। অন্ধকার চারিদিক। দিকহারা হয়ে এক পা – দু পা করে রুমের কাছে যেতে এক পলকের জন্য যেটা চোখে পড়লো তা দেখে আমি জ্ঞান হারালাম।
পরের দিন আমার রুমের সহকর্মীটি সকালবেলা আমাকে উদ্ধার করে এবং সবকিছু শোনার পর এই বাড়ি ছেড়ে অন্য বাড়ি চলে যাই। সহকর্মী বন্ধুটি জিঙ্গাসা করলো “কি ছিলো সেই রুমে?” আমি অফিস সহকর্মীটিকে জিঙ্গাসা করলাম “তুমি এই রুমে কোনদিন একা থাক নি?” সে বলে “আমি তো বেশিরভাগ দিন বাইরে থাকতাম। কিন্তু যখন রুমে ছিলাম সঙ্গে কাউকে নিয়ে থাকতাম। তাই হয়তো এইসব অনুভব করিনি কোনদিন। অবশ্য এই রুম খুব বেশিদিন হয়নি যে নিয়েছি। আমি কিন্তু হাতে গুনে গুনে এক বা দুইদিন ছিলাম তাও সঙ্গে কাউকে নিয়ে।” আমাকে পরক্ষণেই জিঙ্গাসা করলো “রাতে কি দেখেছিলে? আমি পুরো ঘটনাটি খুলে বললাম। ঘটনাটি শোনার পর আমার রুম পার্টনারটি ঘামতে লাগলো, প্রায় জ্ঞান হারানোর অবস্থা। এই ঘটনার কয়েকদিন পর আমরা লোকমুখে শুনলাম, রুমের মালিকেরই অল্পবয়সি ছেলে নাকি এই রুমের মধ্যেই গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে এবং তার মৃতদেহ নাকি এইখানেই দাফান দেওয়া হয়। সেই রাতের ভয়ঙ্কর স্মৃতি যেন এখনো আমার সারা শরীরে শিহরণ জাগায়।
–:: সমাপ্ত ::–