খোঁজ
******
–:: শ্যামাপ্রসাদ সরকার ::–
দেশ বিভাগের কয়েকবছর পরেই আমার ঠাকুর্দা তাঁর তিনটি সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে এপারে চলে আসতে বাধ্য হন। ঠাকুমার কাছে শুনেছি তাহের শেখ, যে আমাদের ডাব পেড়ে দিত, একরাত্তিরে সটান রান্নাঘরে ঢুকে এসে ঠাকুমাকে সাবধান করে গেছিল। একজন মুসলমান যখন সেকালে এক হিন্দুর ‘পাকশাইল্যায় ঢুইক্যা আইস্যা ‘ জীবন সংশয়ের সাবধান বার্তা জানাতে আসে তখন সেই বিপদের মাত্রাটা সহজেই অনুমেয়। সেদিন রাত্রে কিন্তু হিন্দু মুসলমানের জাতের ছোঁয়াছুঁয়ির নিয়মটা আর খাটে নি ।
পরদিন ভোরেই ওরা চিরদিনের জন্য চারপুরুষের ভিটে ছেড়ে পথে নামেন। ঠাকুর্দারা চলে আসার ঠিক দুদিন বাদেই নাকি আমাদের বাড়িটা কারা জ্বালিয়ে দিয়েছিল। ভিটেটা পুড়ে ছাই হতে হতে পরিবার সমেত আমার ঠাকুর্দা ততোক্ষণে ঝালকাঠি থেকে স্টীমার ধরে নিয়েছিলেন।
ও দেশ থেকে স্মৃতি ছাড়া আর বিশেষ কিছুই ওরা নিয়ে আসতে পারেন নি। ঠাকুমার একটা মীনে করা কাঠের বাক্স ছিল, টুকিটাকি জিনিষপত্র রাখার। সেটা এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত আমাদের ঘরে পূর্ববাংলার মধ্যবিত্ত গৃহস্থালির শেষ নমুনা হিসাবে রাখা ছিল। একদিন যাদের ঘরে মুনিষ, ঝি, চাকর আর বাড়ির লোক নিয়ে প্রায় বিশ-টা লোকের দুবেলা পাত পড়ত তাদের রাতারাতি ভূমিহীন হয়ে অন্নসংস্থানের জন্য অন্যদের মত ‘স্ট্রাগল’ শুরু করতে হল। ট্রেনে চেপে শেয়ালদা অবধি যে জান্তব প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে বাবারা এসে পৌঁছয় তা শুধু ‘এক্সোডাসে’র মতই সমতূল্য হলেও বাঙালীর ইতিহাসে তা আজও গরিমাবিহীন রয়েই গেল।
যাদবপুরের দিকে একটা কলোনীতে কিছুটা জমি একরকম জবরদখল করে উদ্বাস্তুদের সাথে একজোট হয়ে আবার ঠাকুর্দা দরমার ঘর বাঁধেন। ঠাকুমাও আবার নতুন করে সংসার শুরু করতে থাকেন। পূর্ববাংলায় ভাত ছিল অপর্যাপ্ত। এখানে কন্ট্রোলের কাঁকর দেওয়া চালে অভ্যস্ত হতে হতে আটার রুটিও একদিন হেঁসেলে ঢুকলো। ঠাকুর্দারা ক’জন মিলে ‘নব ব্রজমোহন প্রাথমিক বিদ্যালয়’ নামে একটা ইস্কুল খুলে কলোনীর বাচ্চাদের পড়াতে শুরু করলো। বাবা আর ছোটকাকাও এখানেই ভর্তি হল আর বড় পিসির ষোল বছর বয়সে বিনা পণেই বিয়ে হয়ে গেল রাজপুরের গাঙ্গুলীবাড়িতে বেশ অবিশ্বাস্য ভাবে।
ছোটকাকা কিছুদিন ফার্স্ট ডিভিশনে ক্লাব ফুটবল খেলে জামশেদপুরে চাকরী নিয়ে চলে যায়। তারপর ওখানেই বিয়ে করে থিতু হয়ে যায় পাকাপাকি। আর বাবা বঙ্গবাসী কলেজ থেকে বি এ পাশ করে পোস্ট অফিসে একটা ভদ্ররকমের সরকারী চাকরী পেয়ে গেলে সংসারটা আস্তে আস্তে আবার দাঁড়িয়ে যায়। এরই মধ্যে কলোনীর একটি মেয়ে সেও একটা কাছেপিঠের ইস্কুলেই পড়াতো তার সাথেই বাবার হঠাৎ বিয়ে হয়ে গেল। ‘মেঘে ঢাকা তারা’র নীতার মতই আরও একটি ভূমিহীন উদ্বাস্তু পরিবারের শিক্ষিতা, সংবেদনশীল, লম্বা বিনুনীর সেই উনিশ বছরের হরিণকালোচোখের তন্বী ‘সীমা’র গর্ভেই এক বর্ষার সন্ধ্যায় আমার জন্ম।
ঠাকুমা যখন মারা যায় তখন আমি প্রায় বছর বারোর। ঠাকুর্দা কিন্তু তখনও বেঁচে। প্রায় চল্লিশবছরের বিবাহিত জীবনের চিরকালের বিচ্ছেদটি তাঁর মেনে নিতে তাঁর কোনো কষ্টই হয়নি। আসলে তার কয়েকবছর আগে থেকেই ঠাকুর্দার বর্তমান স্মৃতি লোপ পেতে থাকে। সবার সাথে কথা খুবই কম বলতেন, আর যাও বা বলতেন তার অধিকাংশই ছিল পূর্ববাংলার স্মৃতি। বরিশাল, ব্রজমোহন স্কুল, সিরাজগঞ্জ এসব অর্থহীন নাম প্রলাপের মত অর্ধস্ফূট স্বরে সেই বৃদ্ধ উচ্চারণ করতেন শুধু। যে সব নাম না জানা মাছ যা শুধু ওপার বাংলাতেই পাওয়া যায় তাই বাজার থেকে কিনে আনার জন্য মা’কে করুণ স্বরে আর্জি জানাতেন। অথচ বিছানার পাশটি থেকে চিরদিনের মত যে ঠাকুমা উঠে চলে গেছে তা তাঁর বোধের অগম্য হয়ে গেছে ততোদিনে।
আমার জন্মের কিছু পরে বাবা গড়িয়ার দিকে খুব সস্তায় বাস্তু জমি পেয়ে যান। প্রায় তিনকাঠার ওপর জমিটাতে বাড়ির সাথে একফালি বাগানও করেছিল মা। আমি জ্ঞান হওয়া ইস্তক ওই বাড়িতেই বড় হয়েছি। একদা ভূমিহারানো উদ্বাস্তু পরিবারে একটুকরো নিজস্ব বাসস্থান যে কতটা মূল্য রাখে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। কিছু বাহারী মরসুমী ফুলের গাছ আর খুচরো সবজী আমাদের নিজেদের বাগানেই জন্মাত।
সেদিন ছিল আমার জন্মদিন। আষাঢ়মাসে জন্মানোর দরুণ জন্মদিনে বৃষ্টি একরকম ধরাবাঁধাই ছিল। বাবার অফিস থেকে হাফ্ ডে করে আসার কথা আর মা রান্নাঘরে টুকিটাকি ব্যস্ত। ততোদিনে ঠাকুমা মারা গেছেন বলে ঠাকুর্দাকে সর্বক্ষণ দেখাশোনার জন্য একজন লোক রাখা হয়েছিল যে ওনাকে স্নানটান করিয়ে দিত, বিকেলে একটু বেড়িয়ে আনতো সে হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে এসে মা’কে খবর দিল ‘বুড়োবাবু’কে কোত্থাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। ঘরের দরজা হাট করে খোলা আর বাইরে ততোক্ষণে শুরু হয়েছে তুমুল বৃষ্টি। এদিকে বাবাও ফেরেননি তখনো। ঠাকুর্দা তখন প্রায় অর্ধোন্মাদ,কোথায় চলে গেছেন নিজের খেয়ালে কে জানে? মা একটা সাংঘাতিক বিপদের প্রমাদ গুনতে লাগলো। বাবা ফিরে এসেই ওই বৃষ্টিতে খুঁজতে বেরোল, কিন্তু কোথাও ঠাকুর্দা কে খুঁজে পাওয়া গেল না। শেষে বাবলুদা (যে ঠাকুর্দাকে দেখাশোনা করত) তাঁকে আবিষ্কার করল আমাদেরই বাগানের একটা কোণে। ওই প্রচন্ড বৃষ্টিতে সম্পূর্ণ ভিজে অবস্থায় ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে তিনি খুরপি দিয়ে মাটি খুঁড়ছিলেন আর আধো অস্ফূট স্বরে বলছিলেন
“আমাগো বরিশাইল্যের মাটি.. এহানে থুইয়্যাছিলাম ! সব ধুইয়্যা যায় ! জলে সব ধুইয়্যা যাইতাছে… সরমাআআআ তুমি শুনতাছ..”
ঠাকুমার মৃত্যুর অত বছর পর এই প্রথম ঠাকুমার নাম উচ্চারণ করলেন তিনি। সবাই ধরে ধরে গা হাত পা মুছিয়ে, পরিষ্কার করে ঠাকুর্দাকে কম্বল জড়িয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। মনে আছে খুব কাঁপছিলেন ঠান্ডায় ! তারপর আর ঠিক দু দিন বেঁচে ছিলেন সেই বৃদ্ধ। এক দেশে জন্মে আর অন্য একটা দেশে জীবনের পঞ্চাশ বছর কাটিয়েও তাঁর সেই ফেলে আসা ভূখন্ডের অবশেষকেই খুঁজতে খুঁজতে তিনি যেন মৃত্যুকে ডেকে নিলেন। তাঁর সেদিনের ভিজে যাওয়া কাদামাখা পোশাকে যে কাদামাটি লেগেছিল লেপ্টে, তাকে সেই অর্ধোন্মাদ বৃদ্ধটি জীবনের উপান্তে এসে শুধু তাঁর জন্মস্থানের সাথে পৃথক করে একবার নিজের মত করে অনুভব করতে চেয়েছিলেন মাত্র।
আজন্মকালের সেই মাটিটুকুর খোঁজ উত্তরাধিকারসূত্রে আমাদের ধমনীতে তাই চিরকাল বয়ে যাবে অকারণেই।
●¤●¤●¤●¤●¤●