শিকড়
************
–:: শ্যামাপ্রসাদ সরকার ::–
প্রবাসের বাঙালিদের মধ্যে নাকি বাঙালিয়ানা কম, অন্ততঃ যারা প্রবাসে জন্মেছেন,তাদের তো মধ্যে তো বটেই। এটা যদিও খুবই সাধারণ একটা ধারণা। আসলে প্রবাসী প্রজন্মের উৎসমূলে যারা আছেন তাদের এমন অনেকেই যারা পূর্ববঙ্গ থেকে বিতাড়িত হয়ে সাতচল্লিশ বা একাত্তরের পরে কলকাতার পাশাপাশি ভারতের অন্য রাজ্যে যখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিলেন জাস্ট বেঁচেবর্তে থাকার তাগিদেই। তখন তাঁরা প্রাদেশিক কৌলীন্যের থেকেও শ্রমের দ্বারা প্রতিষ্ঠাকেই মূখ্যভাবনায় স্হান দিয়েছিলেন।
তারও প্রায় অর্ধশতক পরে আই-টির জোয়ার এসে বাইরের দরজাটা পুরো খুলে দিয়ে বাঙালিকে বারমুখো করে দিল। চাকরির গ্ল্যামার, মোটা মাইনে আর নামী কোম্পানির ট্যাগ লাগিয়ে বাঙালি তখন নতুন করে গ্লোবাল হলো।
***
কুহু আর ঋক এমনই এক সর্বাথে আধুনিক, বিশ্বায়নমুখী, স্বনির্ভর এক সুখী দম্পতি। তাদের সংসার ব্যাঙ্গালোরের দয়ানগরের স্বস্ত্বিক কমপ্লেক্সে, টাওয়ার বি’র ষোলতলার দুশো সাত নম্বর ফ্ল্যাটে। এটি এলাকার অন্যতম বিলাসবহুল আবাসন। সবরকমের আধুনিক সুব্যবস্থা এখানে সুলভ। স্বামী -স্ত্রী দুজনেই আই-টি ইঞ্জিনিয়ার। এরা দুজন ছাড়াও আর একজন সাড়ে চার বছরের মেম্বার আছে বাড়িতে। তার নাম রূপ, দম্পতিটির একমাত্র সন্তান। জন্ম থেকেই সে পুনে আর হায়দ্রাবাদের আকাশই দেখেছে। ইদানীং ব্যাঙ্গালোরকে সে দেখছে এই মাস চারেক হল। অবশ্য বছরে একবার কলকাতা সেও বেড়াতে যখন যায় দাদান আর ঠাম্মীর কাছে, সেখানকার আকাশ তো এমনিতেই বড্ডই ধোঁয়াটে ভালো করে দেখা হয়ে ওঠে না। উঁচু উঁচু ফ্ল্যাটবাড়িগুলো আকাশকে যেন চাপা দিয়েই মাথা তুলে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে। বরং দাদানের সাথে বাগানে খেলতে আর দৌড়াতে সে খুব ভালোবাসে।
***
পূজোর কটা দিন স্বামী স্ত্রী অল্টারনেটিভ শিফ্টে অফিস করছে বাধ্য হয়ে। যে গভর্নেস মহিলা রূপকে দেখাশোনা করে সে বাঙালি। তাই পূজোর কটা দিন ছুটি নিয়ে সে বাড়ি গেছে। কাজেই বাধ্য হয়েই এই ব্যবস্হায় দায়ে পড়ে কখনো কুহু ছেলের জন্য ব্রেকফাস্টে চিজ্ ওমলেট বানাচ্ছে, আবার কখনো বা ঋক রাতে বেডসাইড ল্যাম্প জ্বালিয়ে ‘এসপস্ ফেবল ‘ পড়ে শোনাচ্ছে রূপকে ঘুম পাড়ানোর তোড়জোড় করে।
***
পূজোর কটাদিন নবমী অবধি পুরোদমেই অফিসই চললো। এরই ফাঁকে ফোকরে কয়েকটা ঠাকুর তবুও দেখিয়ে এনেছে ওরা রূপকে। বাড়ির কাছেই বাঙালিদের কালীবাড়ী আছে একটা। ওইখানেই দিনান্তে একবার হল্ট করা হয়ই। প্রবাসী বাঙালিদের এই পূজোটায় বাজেট কম কিন্তু আন্তরিকতাটা ভরপুর আছে।অনেক কটা বাঙালী খাবার আর শাড়ি টাড়ির দোকান বসে এই কদিনের জন্য। সারাবছর কসমোপলিট্যান হবার পর এই পাঁচদিনের বাঙালিয়ানাটা এখানকার সবাই খুব উপভোগ করে। আলমারি থেকে বের করা ন্যাপথলিনের গন্ধমাখানো জামদানী,ঢাকাই, সাবেকী গয়না,ধূতি পাঞ্জাবী পায়জামা, এগুলো চোখ টানে সবারই।
***
রূপও কিন্তু ঠাকুর দেখে খুবই এক্সাইটেড। রোজ নতুন নতুন জামা পড়ার সাথে সাথে প্যান্ডেলে অত্ত বড় বড় সিংহ, অসুর, ময়ূর, পেঁচা এই ব্যাপারগুলো ওর কিন্তু দারুণ লেগেছে। দুগ্গামা আর তার ছেলে মেয়েরাও এখানে দেখতে কি সুন্দর। পুরো ব্যাপারটাই বেশ জমজমাট। এই গল্পগুলো সবই ও কার্টুনে দেখেছে। এতদিন ওর ধারণা ছিল কার্টুনে যা যা দেখায় তা সবই ছোটদের খেলবার জিনিস। বড়রা তাহলে এই কার্টুনগুলোকেও ‘নমো’ করে?
***
এদিন ওর বাবাই রূপকে একটা ক্যাপ পিস্তল কিনে দিয়েছে। ফটফট্ শব্দের সেই পিস্তল নিয়ে বেশ একটা গম্ভীর চালে সে কালীবাড়ির মন্ডপে ঘুরে বেড়ায়।
***
আজ বিজয়া দশমী। এখানকার ভাষায় দশেরা’। রামলীলা আর রাবণ জ্বালানোর ফাঁকে কলকাতার সেই ‘বল দুগ্গা মাইকী..’ হাঁকটা কোথায় হারিয়ে গেছে! এখানে বেশীর ভাগ দূর্গা অসুরদলনী, মাতারানী, সর্বমঙ্গলা রক্ষাকত্রীই শুধু। বাঙালির আটপৌরে ঘরের মেয়ে উমা’র যে অন্য পরিচয়ও একটা আছে তার খোঁজ এখানে কেউ রাখেনা। নবরাত্রির ডান্ডিয়া খেলার হুজুগটাও বেশ চোখে পড়ার মত।
***
দশমীর দিনটা এলেই কুহুর মনখারাপ করে খুব। কোলকাতার জন্য মন টানে। ওদের সময়কার ছোটবেলার পূজোর আমেজটা রূপকে আর দেওয়া হলনা। রূপদের ছোটবেলাটা একদমই অন্যরকম। ছোটবেলায় বাবার সাথে কয়েকবার লরিতে চেপে ক্লাবের ঠাকুর আনতে গেছিল, সেইসব নির্মল আনন্দগুলো রূপকে আর দেওয়া হয়ে উঠবে কি?
***
ঋক আর রূপ সারা দুপুর পরে পরে ঘুমালো। সেই সুযোগে এরই একফাঁকে আলমারী থেকে মায়ের লাল পেড়ে গরদটা বের করে পরে ভাঁজ খোলে কুহু।শাড়ীটার গায়ে হাত বুলিয়ে যেন মা’এর টাটকা স্পর্শটা পায়। মা’ চলে গেছে দু’বছর হয়ে গেল দেখতে দেখতে। বাবা ও কলকাতার পাট চুকিয়ে একটা ছোট বাড়ি কিনেছে শান্তিনিকেতনের ভুবনপল্লীতে। আসলে এখন নামেই কলকাতা যাওয়া। এয়ারপোর্টে পা দেওয়া আর ঋক দের উত্তর কলকাতার বাড়িতে দু রাত থেকে বাবার কাছে চলে যায় কুহু। এরই মাঝে ছোট্ট ছোট্ট ট্যূরে পুরী বা দার্জিলিং এ ঢুঁ মেরে আসা। ব্যস্ত আই টি প্রফেশনালদের অত লম্বা ছুটি আজকাল পাওয়া যায় না।
কুহু বাক্স খুলে বিয়ের সময়কার সোনা বাঁধানো শাঁখা পলা যেগুলো লকারেই সারাবছর শীতঘুমেই থাকে,সেগুলো পড়লো। গলায় উঠলো একটা সাবেকী সীতাহার আর তারপর কপালে একটা বড় করে লাল সিঁদূরের টিপ আঁকল। ক’মাস আগে ওগুলোকে ব্যাঙ্ক থেকে তুলেছিল বলে এখনও কাছে রয়ে গেছে।
বাপ বেটাকে ঘুমন্ত অবস্থায় রেখেই কুহু শিকড়ের টানেই কালীবাড়ি বেড়িয়ে গেল। মিসেস মুখার্জ্জী কাল বলছিলেন সেখানে একটু পরেই সিঁদূরখেলা শুরু হবার কথা।
***
ঋক কিন্তু ঘুম থেকে আগেই উঠে পড়ে কুহুকে জানান না দিয়েই চুরি করে ওর সাজগোজ দেখছিল বিছানা থেকেই। অনেকদিন পর কুহুর বয়েজ কাট চুল আর কর্পোরেট এ্যটায়ার থেকে এই শাপমুক্তিটা উপভোগ করছিল নিশ্চুপে।
***
কুহু যখন ফিরল ওর মুখটা সিঁদূরে পুরো লাল। মাথার চুল, শাড়ি সবেতেই বাঙালি এয়োস্ত্রীর চিহ্ন জড়ানো। ঋক আর দেরী না করে তার দামী ক্যামেরায় ক্লোজআপ নিচ্ছিল অগুন্তি।
ঋককে অবাক করে কুহু কতদিন পর যে আবার লজ্জ্বা পেল ! প্রবাসে থেকেও শিকড়ের টানটা যে বড় বালাই দুজনে সেটা পরস্পরকে আদর করতে করতে ভাগ করে নিচ্ছিল।
***
এত কিছু চমকপদ ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর রূপ হঠাৎ চোখ চেয়ে দেখে তার এই কদিনের দেখা প্যান্ডেলের দুগ্গাঠাকুর ওকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎ তাদের বাড়িতে এসে ঠিক তার মা’র মতো করে কথা বলছে মিষ্টি গলায়।
○●○●○●○●○●○
অসাধারণ লেখা 💐💐