“হোস্টেল লাইফ”
◆◇◆◇◆◇◆
–:: ইন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায় ::–
(সহকারী শিক্ষিকা, পলাশী হেমাঙ্গিনী সরোজিনী বিদ্যামন্দির)
মণিদীপা হোস্টেলে ঢুকেই দেখলো সুদেষ্ণাদির মুখভার।ঘরে যেন পিন পরলে শব্দ পাওয়া যাবে। রীণাটাও গম্ভীর। সবকটা চোখ এখন ওর দিকেই নিবদ্ধ।বুঝলো সেই এক সমস্যা।
এই হোস্টেলে মোট ষাটটি মেয়ে থাকে।এক নম্বর ঘরে ওরা আটজন। বেশ ঘিঞ্জি থাকতে হয়। এক একদিন বিরক্তি তে মনটা ভরে যায়। সন্ধ্যাদি আর ধনঞ্জয় দেখভাল এর দায়িত্বে। মাসে সাতশ করে টাকা লাগে খাই খরচা বাবদ। এটা বি এড কলেজের হোস্টেল।ছেলেদের ও হোস্টেল আছে। সন্ধ্যা ছটার পরে সকলকেই ঘরে ঢুকতে হবে।
মণি বাড়ি গিয়েছিল। পেটে ছুঁচোর ডাক।কিছু খেতে হবে। হাত পা ধুয়ে ও সন্ধ্যাদির কাছে গেল। যাকগে। আজ ভাত জুটে গেল।ডাল,আলুপোস্ত আর সিলভার কাপ মাছের ঝাল।এই সময় রুই কাতলা রান্না হয় না।খরচে কুলোয় না। তবে গ্ৰীষ্মের ছুটি বা স্টাডিলিভে যখন অনেক মেয়ে বাড়ি যায় একসাথে তখন খাওয়ার মজাই আলাদা। যাকে বলে রাজকীয়।
পেটে ভাত কটা পরতেই চাঙ্গা হল মণি। ওর পাসের বেডেই থাকে খুশি। আসানসোলের মেয়ে। বেশ চটক আছে। আর উচ্ছল।মণির সব পোশাক আগে খুশি পড়ে। তবে পড়াশোনাতে ফাঁকি নেই। মণি খুশিকে ভূতের ভয় দেখিয়েছে একদিন। আর টিকটিকির ভয়।
খুশি বললো পুরো ঘটনাটা। সুদেষ্ণাদি আজ বাড়ি থেকে ফিরেছে সকালে। ব্যাগটা রেখে টয়লেটে গিয়েছিল। এসে দেখে ব্যাগ থেকে দুশো টাকা হাওয়া। মণি কিছুটা নিশ্চিন্ত হয় এই ভেবে যে সন্দেহের তালিকায় সে নেই। কারন সে এইমাত্র এল।
এই নিয়ে প্রায় ছবার হল টাকা চুরি। এতদিন দশ টাকা বা কুড়িটাকা যেত।আজ দুশো। সকলের মুখেই বিরক্তির ছাপ।
বাড়ি থেকে এলেই একটা মনখারাপ গ্ৰাস করে। বিশেষ করে মা এর করুণ মুখটা মনে খোঁচা দেয়। আজ দেবীপ্রসাদ বাবুর ক্লাস আছে। উনি মণিকে খুউউব স্নেহ করেন। ভীষণ রাগী মানুষ। মানে খনে রুষ্ট খনে তুষ্ট আর কি। রাগী মানুষ রা মনের দিক থেকে উন্নত হন।
মদনমোহন বাবু এডুকেশনাল সাইকোলজি পড়ান। এই দুটো ক্লাসে থাকতেই হবে মণিকে।আজ বাড়ি থেকে একটা শাড়ি এনেছে মণি। ফুলিয়ার তাঁত। কালো মেঝেতে গোল্ডেন। মণিকে শাড়ি পরলে খুব ভালো লাগে। হালকা লিপস্টিক আর কুন্দনের সেটে মণিকে আজ অসাধারণ লাগছিল।খুশি বললো কাল এই শাড়িটা আমাকে দিবি। খুশি র এই ছেলেমানুষী বেশ লাগে।
মদনবাবু রসিক মানুষ। ব্যক্তিবৈষম্য পড়াচ্ছিলেন। মণিকে দেখেই বললেন মা এর আদর খেলে চলবে না। লেখাপড়ায় মন দাও।মণি মদনমোহন বাবুর পড়ানোর পদ্ধতিতে আপ্লুত হয়ে যায়।
উনি বলেছেন
“ভেক কা ভালা বরষা বাদল
অজ কা ভালা ধূপ,”
সত্যিই। প্রতিটা মানুষ প্রতিটার থেকে আলাদা। স্কুলে পড়াতে গিয়ে ওটাই তো সমস্যা হয়। সবাই তো একরকম হবে না।
পরপর দুটো ক্লাস করে হোস্টেলে ফিরলো মণি। কেউ নেই।কলেজে সবাই। চেঞ্জ করে হালকা হ ওয়া গেল। সকালে বিস্কুটের কৌটো ভরেছিল। দেখলো অর্ধেক। কেউ খেয়েছে। তা খাক। কী আর হবে। বন্ধু তো।
ঘরের আটজন প্রত্যেকেই আলাদা প্রত্যেকের থেকে। মদন বাবুর কথাগুলো মনে পড়ছিল। মণি, মৈত্রেয়ী, খুশি, সাগরিকা, সুদেষ্ণাদি, বুলা, অনামিকা, রীণা। সবাই কত ভালো। ওদের মধ্যেই আবার একজন চোর। টাকা চুরি করে। হাসি পায় মণির। এরাই তো ভবিষ্যতের শিক্ষিকা।
মণি জানে পৃথিবীর সব থেকে বড় শিক্ষক হলেন মা। মা এর শিক্ষা একটা শিশুকে আজীবন পরিচালিত করে। আমাদের কত অপসঙ্গতি। কেউ মিথ্যে বলে, কেউ চুরি করে। ছোট থেকেই এর বীজ বোনা হয়ে যাবে যদি মা সচেতন না হন।
যাইহোক। চারটে বাজতেই সবাই হাজির। দশ নম্বর রুমে পূর্ণা দি দের ঘরে চলে যাচ্ছে সুদেষ্ণাদি। খুউউব খারাপ লাগছে। অথচ বোঝা যাচ্ছে না কে এই অপকর্ম টি করছে।ধরতে পারলে প্রিন্সিপাল এর কাছে নিয়ে যাবে মণি।
সরিতা দি আর অপর্ণা একটা ছোট্ট ঘরে থাকে।সরিতাদি শিক্ষিকা। মণির থেকে বছর
দশেকের বড়ো। এখন তো বি এড না করা থাকলে ইনক্রিমেন্ট বন্ধ হয়ে যাবে তাই এখানে।ওরা এইসময় পুরো বেতন পায়।
সন্ধ্যায় সরিতাদি মণিকে ডাকলো। গান শোনা মণি। মণি বিবেকানন্দের ভালো লাগা গান গায়। হোস্টেলের পাশে অধ্যক্ষ থাকেন।চোখে রেটিনার প্রবলেম। আর সেই কারণেই মাঝে মধ্যে ক্লাস নেন। জানালায় দাঁড়িয়ে তিনি গান শুনছেন। কিছুক্ষণ পরে ডাকলেন।কে গায়। মণিদীপা নাকি। আরো গান শোনাও। মানুষ টি অত্যন্ত শ্রদ্ধেয়। এমন মানুষ কে গান শুনিয়ে। মণির মন ভালো হয়ে যায়।
জীবনের ধন কিছুই যায় না ফেলা। কত মানুষ জীবনে এমনি আসে। যাঁরা জ্যোতির্ময়। অন্তরে আলো বর্ষণ করেন।
এদিকে নতুন খবর। স্কুল সার্ভিস কমিশনে বুলার নাম। ভাবা যায়। কত আর বয়স। বাইশ কী তেইশ। মণির সমবয়সী। খবরটা শুনে বুলাকে জড়িয়ে ধরে মণি। সকলে আবদার করেছে বুলাকে খাওয়াতে হবে।
অনেকক্ষণ বুলার কাছে থাকে মণি। ওর ও ইচ্ছা।বুলার মতো শিক্ষিকা হবে। কত সম্মানের।স্কুলের হেড স্যর বলতেন শিক্ষকতা চাকরি নয়। সেবা।
বুলা জানায় সে মাংস ভাত খাওয়াবে। আর একটা কথা শুনে বুলার প্রতি শ্রদ্ধা দ্বিগুণ হয়ে যায়। ও বলেছে প্রথম মাসের মাইনেটা ও কাকাকে দেবে। কাকার আর্থিক অবস্থা ভালো নয়।
বুলাকে স্কুল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে বি এড কমপ্লিট করতে। ম্যানেজিং কমিটির সিদ্ধান্ত। আর তিন মাসের জন্য বছরটা নষ্ট করে কি লাভ।পরীক্ষা আসন্ন। সবার মধ্যে এখন পড়াশোনা ছাড়া অন্য চিন্তা নেই। প্রত্যেকে স্বাবলম্বী হতে চায়।অত এব দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই।খুশির পড়ার পদ্ধতিটা বেশ ভালো লাগে।মনে রাখা যায়।
বুলার অনেক গুণের মধ্যে ডায়েরি লেখা একটা ভালো দিক। শুতে যাবার আগে ডায়েরি লেখে ও। এ নিয়ে খুশির ঔৎসুক্য। ও বলে তুই প্রেম করছিস বুলা। সত্যি বল। রাধামাধবকে তুই ভালোবাসিস কিনা। কলেজে ও তোকে ড্যাবড্যাব করে দেখে। বুলা হাসতে থাকে। মণিও বেশ আমোদ পায় ওদের কথায়।
খুশি বলে ডায়েরি তে রোজ ওর কথাই লিখিস বুঝি?
সিরিয়াস পড়াশোনার মাঝে এই ধরনের কথা মনটাকে হালকা করে।
কিছুদিন আগে খুশির প্রেমিক এসেছিল।বেশ দেখতে। সরকারী চাকুরে। খুশির সাথে দেখা হয় নি। বুলা তার সাথে কথা বলে। এরপর থেকেই খুশির রাগ।
আজ হোস্টেলে মণি আর খুশি আছে। বাকিরা কেউ কলেজে আর কেউ বা বাড়ি গেছে। বুলার ভূগোল প্রাকটিক্যাল আছে। হঠাৎ মণি বলে উঠল আচ্ছা খুশি। বুলা ওই ডায়েরি টায় রোজ কী লেখে বলতো। নারীসুলভ কৌতূহল সাংঘাতিক। দুজনেই ছুটে গেল ওর বেডে।ডায়েরি খুলে দুজনের চোখ ই মার্বেল। এসব কী পড়ছে ওরা।হায় কপাল। কাঁদবে না হাসবে।
ভারি অদ্ভুত এই মানবচরিত্র। এর তল পাওয়া ভার। যে বুলার এত গুণ সেই বুলাই ডায়েরি তে লিখেছে তার চুরির কথা। প্রতিদিন সে কী কী চুরি করেছে সব লিখেছে। সার্ভিস পাওয়ার পরেও। আর সর্বশক্তিমান এর কাছে ক্ষমাও চেয়েছে।
খুশি ডায়েরি পড়ে পর্যন্ত স্থির নেই। এরজন্য কত কী পোহাতে হল। সুদেষ্ণাদি কে ডেকে দেখালো খুশি। উনি বিচক্ষণ মানুষ।আমাদের লম্ফ ঝম্ফ করতে মানা করলেন।
প্রিন্সিপাল পরের দিন সমস্ত ঘটনাই শুনলেন। বললেন এটা ওর অপসঙ্গতি। তোমরা ওকে বোঝাও। এই অবস্থায় আমার কোনো কথা ওকে আঘাত করলে আত্মহত্যাও করে ফেলতে পারে। যত হোক উনি শিক্ষিকা ।
এদিকে রুমে এসে ডায়েরি দেখতে না পেয়ে বুলা যা বোঝার বুঝেও গেছে। ধরা পড়েছে ও। ঝরঝর করে চোখ দিয়ে অশ্রু পরছে।ওই অশ্রুতেই ওর সব অপরাধ ধুয়ে যাচ্ছে।
এদিকে পরীক্ষা তে আবার ব্যস্ত সবাই। এরপর চলে যাবে সবাই। নিজের জায়গায়।
মণি এখন ভাবে বুলা কী ওই দোষ থেকে বেরিয়ে যেতে পারবে।
◆◇◆◇◆◇◆