পূর্বমেঘ
◆◇◆◇◆
–:: শ্যামাপ্রসাদ সরকার ::–
উজ্জয়িনীর মহাকাল মন্দির। সুপ্রাচীন কাল থেকে অনুষ্ঠিত এই রহস্যাবৃত ভস্মারতি সমাপনের আর সামান্যই বাকী। এ এক আশ্চর্য প্রকারের আরতি। মধ্যরাত্রির দুই প্রহরে জ্যোর্তিলিঙ্গটিকে প্রথমে রাজকীয় শৃঙ্গার বেশে সাজিয়ে ক্রমশ তার উপর শ্মশানের চিতাভস্মের প্রলেপনের পর মৃদঙ্গ, ডম্বরু আর শতশৃঙ্গ বাদ্য সহযোগে এই আরতি অনুষ্ঠিত হয়। শৈবাধূত সন্ন্যাসীদের এ এক অতীব গূঢ় সাধন পদ্ধতি। যেন শ্মশানাচারী মহাকালের উপযুক্ত উপাচার বটে। অনিত্য, জাগতিক মোহ মায়ার মাঝে কেবল সত্য, শিব, সুন্দরই যে অটল এই গূঢ় তত্ত্বটি কি সহজেই পরিবেশিত হয় তাঁর পূজার প্রকরণে। শুধু রাজপরিবারের পুরুষ ও তাঁদের অন্তরঙ্গ সহচর ব্যাতীত নিষ্প্রদীপ প্রায়ান্ধকার গর্ভগৃহে এ সময়ে অন্য কারো প্রবেশ নিষেধ। আজ স্বয়ং রাজাধিরাজ পরমভট্টারক বিক্রমাদিত্য আর তাঁর রাজসভার রত্নরাজির অন্যতম বেতালভট্ট ও শঙ্কুদেব তাঁর সঙ্গে এই অত্যাশ্চর্য আরতির সাক্ষী হবার বাসনায় সমস্ত মধ্যরাত্র থেকে জাগরূক।
***
গবাক্ষপথে প্রথম ঊষার ক্ষীণ আলোক ধীরে ধীরে মন্দিরপ্রাঙ্গনকে আলোকিত করছে। ভস্মতিলক ললাটে অঙ্কিত করে সপার্ষদের সাথে শ্রীমন্মহারাজ মন্দির প্রাঙ্গণে এসে উপবিষ্ট হলেন। এসময়ে কোনও সাধারণ্যের প্রবেশ নিষেধ। প্রতিহারী ও দুর্দান্ত রক্ষীবেষ্টনীতে মন্দিরপ্রাঙ্গণের সমস্ত এলাকার দূরতম প্রান্তটিও অবধি শৃঙ্খলে নিবদ্ধ। কিছুদিন পূর্বেই দূর্ধর্ষ শকদস্যু বিতাড়ণ করে ‘শকারি’ উপাধি তিনি লাভ করেছেন। আজ সেই মনোস্কাম পূর্তির বিশেষ পূজা অবশেষে সমাধা হল।
****
মন্দিরের সংযুক্ত কাননটি পুষ্পশোভিত।
বড় মনোরম এই ঊষাকালের পবিত্র ভাবটি। বেশীক্ষণ এর সংস্পর্শে থাকলে এই রাজপদ তুচ্ছ করে নগাধিরাজ হিমালয়ের টানে বানপ্রস্হে যাত্রা করতে মন উন্মুখ হয়!
এরপরের গন্তব্য শিপ্রানদীতট। সূর্যপ্রণাম ও প্রাতঃস্নানের পর প্রফুল্ল চিত্তে শিপ্রাতটে মৃদুমন্দ মলয়সেবনের জন্য তিনি খানিক সময় ব্যয় করেন। রাজকার্যের বিড়ম্বনা থেকে মুক্তির এ এক সাময়িক নিষ্কৃতি। শিপ্রাতটভূমি থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় মহারাজ এক সুপুরুষ যুবাকে দেখতে পেলেন উদাসী নয়নে আকাশপথে মানসবিহারে মগ্ন। শঙ্কুদেব বললেন যে যুবাটি উজ্জয়নীতে নবাগত। শিপ্রার তটে একটি পরিত্যক্ত পর্ণকুটিরে এর বাস। দেহে উপবীত আছে যখন, তখন এ ব্যক্তি ব্রাহ্মণ নিশ্চয়। তবে এ ব্যক্তিটি সদা তদ্ভাবে থাকে,এখনো পর্যন্ত যদিও এর দ্বারা কারো অনিষ্ট করার সংবাদ প্রাপ্ত হয়নি।
****
আজকের প্রভাতটি অবশ্য রৌদ্রকরোজ্জ্বল নয়। পূর্বাকাশে কিঞ্চিৎ নবজলধরের সিঞ্চন হয়েছে। আজ আষাঢ় মাসের প্রথমাতিথি। সপার্ষদে সেদিনকার মতো মহাকালেশ্বরে পূজার্চনা ও প্রাতঃকালীন স্নান সমাপন করে প্রাসাদ অভিমুখে যাত্রা করলেন বিক্রমাদিত্য।
কিঞ্চিৎ বেলা বর্ধিত হলে রাজপ্রতিহারী রঙ্কপাল শিপ্রার তীরে সেই পর্ণ কুটিরটির সামনে এসে দাঁড়ায়। মহামহিম রাজচক্রবর্তী স্বয়ং বিক্রমাদিত্য এই বিদেশী ব্রাহ্মণ তনয়টির সাক্ষাৎ অভিলাষী। ব্রাহ্মণটি সুগৌর ও দিব্যকান্তি। নগরে বোধহয় বেশী কারুর সঙ্গে পরিচিত নয়। স্বভাবে নম্রভাষী ও লাজুক।
নচেৎ রাজনাগরিকা বজ্রমালা ও তার কিন্নরী সদৃশ সখীগণ এই অনুপম পুরুষটির সঙ্গে একটি মদনরঞ্জিত নিশাকাল ব্যয় করতে কুন্ঠিত হত না।
****
দেবতনয়টি এই আকস্মিক আহবানে বিস্মিত হয়। তার কোন ধারণাই নেই যে তার মত নিতান্ত নিরীহ ব্রাহ্মণ সন্তানের এই রাজসম্ভাষণের কারণ। সে বণিক বা তস্কর কোনওটাই নয়। নিতান্ত অনীহার সাথে তার একমাত্র অবলম্বন একটি ছিন্নপেটিকা সঙ্গে করে রঙ্কপালকে অনুসরণ করে।
ইতিমধ্যে উজ্জয়িনীর আকাশে আরও দূর্বাদলশ্যাম মেঘপুঞ্জের সমারোহ ঘটেছে। নানা প্রান্ত থেকে ভাসমান মেঘগুলি পশ্চিম থেকে পূর্বের পথে ধাবিত হচ্ছে। ব্রাহ্মণতনয়টি উদাসদৃষ্টিতে আকাশচারণ করতে করতে পদব্রজে প্রাসাদে এসে উপনীত হয়।
*****
রাজাধিরাজ বিক্রমাদিত্যের প্রাসাদটি স্ফটিকনির্মিত। মহাভারতে বর্ণিত ইন্দ্রপ্রস্থের মতই সুচারু এটি। উজ্জয়িনী ছাড়াও তাঁর আরেকটি রাজধানী আছে মগধে। ওটিতে বর্ষাঋতুর পর পরই তিনি গমন করবেন এমনই অভিপ্রায় তাঁর। বসন্ত থেকে বর্ষার সূচনাসময় অবধি তিনি মহাকালেশ্বরের পাদচ্ছায়া থেকে দূরে থাকতে আগ্রহী নন। মহারাজ বিদূষক বিপুলের সাথে লঘু পরিহাসপূর্বক অক্ষক্রীড়ায় মগ্ন। তিন মাষা স্বর্ণের বিনিময়ে আজকের এই ক্রীড়া। মন্মহারাজ স্বয়ং অক্ষচালনায় পটু, কিন্তু প্রিয় বিদূষককে ঔদার্য্যবশত পারিতোষিক প্রদানের জন্য স্বেচ্ছায় কখনো কখনো হার স্বীকার করে থাকেন।
***
রাজসমীপে যুবকটি অবশেষে নীত হয়। অতি নম্রস্বরে মহারাজ বিক্রমাদিত্য তাঁর পরিচয় জিজ্ঞাসা করেন। ততোধিক নম্রস্বরে তার প্রত্যুত্তর দেয় যুবাটি। সে আসলে মগধ প্রবাসী এক সাধারণ ব্রাহ্মণ তনয়। মাহিষ্মতীর পথে সে যাত্রা করেছিল বটে, কিন্তু পথমধ্যে শিপ্রাতটের সৌন্দর্যে সে মুগ্ধ হয়ে মন পরিবর্তন করে এখানেই স্থিতু হবার বাসনা। ব্রাহ্মণের পিতৃদত্ত নাম কালিদাস।
বিক্রমাদিত্য নিশ্চিন্ত হলেন। যুবকটি প্রকৃতই সরল। গুর্জর প্রতিহার বা চেদী রাজ্যের গুপ্তচর নয় অন্তত। তার আয়ত চক্ষুদুটি কবির। বিশ্বচরাচরের জাগতিক ভাবনার অনেক উচ্চে অবস্হান তার। তিনি জিজ্ঞাসা করেন কোন রাজকর্মে তার রুচি আছে কিনা !
***
অপ্রস্তুত হয় কালিদাস। সবিনয়ে সে জানায় সে রাজকর্মে নিতান্ত অপটু। তবে দিবারাত্রের পরিশ্রমে সে দেবভাষায় একটি কাব্যরচনায় অভিলাষী। কিন্তু সম্প্রতি এক দুরূহ সমস্যায় তার রচনাটি ভাবনার স্তরেই আটকে আছে। মহারাজ বিস্মিত হন, তাঁর রাজ্যের যাবতীয় সমস্যা সকল তো দূরাচারী শকদের সঙ্গে তিনি কবেই বিতাড়িত করেছেন বলে তাঁর বিশ্বাস। তবে এ কোন সমস্যা যা একজন কবির তার কাব্যরচনায় অন্তরায় হয় !
কালিদাস জোড়হস্তে বলে তার কাব্যটি প্রেম ও বিরহের আখ্যায়িকা। নায়ক যক্ষ অলকাপুরী থেকে নিবার্সিত। তার প্রিয়াটি অবশ্য রামগিরি পর্বতে অবস্থান করছে। সে চায় তার প্রণয় উচ্চারণ বিরহবিধূর যক্ষপ্রিয়ার কাছে একটি বার এসে পৌঁছাক। কিন্তু কিভাবে সেটি সম্ভবপর হবে তার ভাবনায় সে অপারগ। তাই প্রতিদিন সে উদাস নয়নে শিপ্রাতটে বসে থাকে।
****
অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন মহারাজ। কবিটি যে প্রকৃতই সহজিয়া ! নটী, প্রণয়ী আর ভার্যা এই তিন প্রকার নারীসঙ্গে স্বয়ং তিনি সদারঙ্গে মেতে থাকতে বড় পছন্দ করেন। নারী ও প্রণয় চর্চায় তিনি চিরকাল উৎসাহী ও অভিজ্ঞ। সহাস্যে গুম্ফ আন্দোলিত করে বলেন, কি আশ্চর্য !
কাউকে তুমি দূত স্বরূপ প্রিয়ার কাছে প্রেরণ করলেই তো বার্তাপ্রেরণের সমস্যাটির অন্ত।
****
কালিদাস করতালি দিয়ে আনন্দে নৃত্য করে ওঠে। যথার্থ বলেছেন মহারাজ! আমি আমার উত্তর পেয়ে গেছি ! জয়ধ্বনি দিতে দিতে সে নিষ্ক্রান্ত হয় রাজপুরী থেকে। বিস্ময়ে মহারাজ তার গমনপথের দিকে চেয়ে থাকেন। পরিবর্তে রোজ তাঁকে এসে কাব্যটির প্রতিটি সর্গ এসে শুনিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করেন শুধু।
****
কালিদাস কুটিরে ফেরে। সূর্যাস্তের এখনো বাকী আছে। আষাঢ়ের প্রথম দিবসটিতেই তাঁর আখ্যায়িকাটি সূচিত হোক। মহারাজের পরামর্শ মত সে দূতই প্রেরণ করবে তার যক্ষপ্রিয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু সে দূত কোনও যক্ষ বা রক্ষ নয় সে হবে আকাশের নববর্ষার কৃষ্ণবর্ণের ‘মেঘ’।
সরস্বতীর পাদবন্দনা করে ভূর্জপত্রে মন্দাক্রান্তা ছন্দে তার কাব্যপ্রবাহ স্রোতস্বিনী হয়ে প্রবাহিত হতে থাকে,
“কশ্চিত্ কান্তাবিরহগুরুণা স্বাধিকারাত্প্রমত্তঃ
শাপেনাস্তঙ্গমিতমহিমা বর্ষভোগ্যেণ ভর্তুঃ .
যক্ষশ্চক্রে জনকতনযাস্নানপুণ্যোদকেষু
স্নিগ্ধচ্ছায়াতরুষু বসতিং রামগির্যাশ্রমেষু…”
◆◇◆◇◆◇◆◇◆