“আমার সাধ না মিটিল”
********
শ্যামাপ্রসাদ সরকার
১৭ নম্বর বটকৃষ্ণ পাল এ্যাভিনিউর হলদে ছোপধরা বাড়িটার বেশ বয়স হয়েছে। তিনপুরুষের মুখোপাধ্যায়দের বসত ভিটে। অষ্টাদশ শতকের গোড়ায় নিমকমহলের দেওয়ানী করতেন রামকমল মুখুজ্যে। তারপর সাহেবদের ক্লিয়ারিং এন্ড ফরোয়ার্ডিং এজেন্ট হয়ে বেশ অর্থ সম্পদের অধিকারী হয়ে এই ভদ্রাসনটির পত্তন করেন। তারপরের পুরুষ তারাচাঁদ মুখুজ্যে বেঙ্গল থিয়েটারে টাকা ঢেলে ফতুর হয়ে যান প্রায়। সেই থেকে প্রথম এ বাড়িতে গান বাজনা ঢোকে। তারাচাঁদের রক্ষিতা ছিলেন মানময়ী দাসী। সেসময়ের নাম করা এ্যাকট্রেস। কুসুমকুমারীর সাথে টক্কর দিতেন। তাঁর কীর্তনাঙ্গের গানে ছিল ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভা। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর ওঁকেই বিবাহ করেন স্কটিশ চার্চ কলেজের প্রাক্তনী তারাচাঁদ আর এই পৈতৃক ভদ্রাসনে স্থান দেন। সে নিয়ে বিস্তর কেচ্ছা কাহিনী এই বাড়ির শিকড় বাকড়ে এখনো কান পাতলে শুনতে পাওয়া যায়। তারাচাঁদের পর নামকরা উকিল যুগলকিশোর মুখুজ্যে আর সেই শাখায় দুটি সন্তান মৃত্যুঞ্জয় আর প্রাণকৃষ্ণ। আজ এঁরা দুজনেই প্রতিষ্ঠিত গায়ক। আসর, রেডিও, জলসা সবেতে মৃত্যুঞ্জয়েরই ডাক আসে বেশী। আজকাল তো ফিল্মেও গাইছেন। আধুনিক গানের তাঁর বেসিক রেকর্ডগুলোর ভালোই বিক্রি এছাড়া টপ্পা আর ভক্তিগীতিও তাঁর কন্ঠে বেশ জনপ্রিয়। প্রাণকৃষ্ণ অবশ্য আরো উচ্চমানের গায়ক হতে পারতেন। গলাও তাঁর বেশী ভাল, একটু চিকন -মিহি, চড়া পর্দার আরোহণেও স্বর স্বাভাবিক থাকে। ওস্তাদ আসাদ খাঁর কাছে খেয়ালেরও তালিম নিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি স্বভাবে কুন্ঠিত ভীরু স্বভাবের মানুষ। একটু নিভৃতচারণপ্রিয়। সেজন্য আজও জনপ্রিয়তা পেলেও অগ্রজের থেকে সামান্য পিছিয়ে আছেন ঠিকই; তবে একটি প্রকার ঐশ্বর্য তাঁরও আছে যা বোধহয় মানময়ী দাসীর উত্তরধারার ক্ষীণরক্তধারা বাহিত। শ্যামাসঙ্গীত আর কীর্তনে তিনি একচ্ছত্র সম্রাট। ভক্তিগীতির এই ধারাটিতে তিনি যে মৃতু্ঞ্জয়বাবুকে হারিয়ে দিয়েছেন এটা বাংলার মানুষও মানে।
রোববারের সকালবেলা লুচি বেগুনভাজা আর সুজির হালুয়া এ বাড়ির জলখাবারে বাঁধা। এখন এ পরিবারের কর্তা মৃত্যুঞ্জয় বাবু ই। ফর্সা রাশভারী চেহারা। চোখের সোনালী হাফ রিমের চশমাটা হাল ফ্যাশানের হলেও এ বাড়ির পুরুষরা এখনো ধূতি ফতুয়া ত্যাগ করেন নি। সত্তরের দশকে টেরিলিন বলে একধরণের কাপড় বোম্বাই ফিল্মের দেখাদেখি ছেলে ছোকরারা পড়লেও ওনার নিজের সাবেকী পোশাকই পছন্দ। লুচির টুকরোটা ছিঁড়ে মুখে পুরতে পুরতে বললেন, ‘ পানু কোথায় ! এখনো ওঠেনি বুঝি?’ স্ত্রী নীপময়ী বলেন ‘ না ! ঠাকুরপোদের ঘরের দরজা বন্ধ এখনো ! উঠবে এবার ! ‘ মৃত্যুঞ্জয় স্বগতোক্তি করেন, ‘পানু টা আর একটু সিরিয়াস হলে আরও নাম করতে পারত। ওর ভক্তিগীতি লোকে ভালবাসে বলে আমি তো আজকাল দু একটা ছাড়া গাওয়া ছেড়েই দিয়েছি ! কিসের ঘোরে যে ও সর্বদা থাকে ! মা গঙ্গাই জানেন !’
প্রাণকৃষ্ণ রেডিওর অফিস থেকে বেরিয়ে একটা ট্রাম দেখতে পেয়েই উঠে গেল। এখন কোথায় যাওয়া যায় ! এই ট্রামটা মনে হয় কালীঘাট ডিপো অবধি যাবে। পকেটে দুবারের আসাযাওয়ার পয়সা রুম্পা রেখে দিয়েছে ঠিক। নিজের ওসবের খেয়াল রাখার দায় নেই। বাকী সব কিছুতেই মাথার ওপর দাদা তো আছেনই। আজকের গানটা ভালো জমেনি। রজনীকান্তের ‘আমি সকল কাজের পাই যে সময়’ ওর নিজের খুবই প্রিয় গান । কিন্তু আজ যেন সুরে তালে জমল না। কেউ সেটা ধরতে পারেনি যদিও, কিন্তু ও নিজে জানে। রেডিওতে গান রেকর্ডিং থাকলে বীরেনদাও আসেন। চুপ করে গান শোনেন নস্যির কৌটো হাতে স্থির হয়ে। দু একবার বীরেনদার চোখে চিকচিকে জলও দেখেছে যেন। ট্রামটা কালীঘাট ব্রিজের কাছে আসতেই টুক করে নেমে যেতে হবে।
নাটমন্দির থেকে দুটো চক্কর দিয়ে ওপারের পথ ধরল প্রাণকৃষ্ণ। ওদিকে কেওড়াতলা। ওখানটায় যেতেই খুব মন টানে আজকাল। দুপুরবেলাটা একটু নির্জন থাকে একটা ঝুপসি বটতলা। ওখানে চুপ করে বসে থাকতে ইচ্ছা হয়। চিতার আগুনে ফট্ ফট্ শব্দ হয়। চামড়া পোড়া গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে থাকে। মনটা খুব হু হু করে ওঠে কেমন। চিতা কাঠ গুলো কি তবে ওকে ডাকে?
বিডনস্ট্রীটের নবরাগ সঙ্ঘের সেক্রেটারি মাখন বাবু আর তাঁর অনুচর কিঙ্কর এখন বৈঠকখানায় বসে। বিজয়া সম্মিলনীতে ওদের মৃত্যুঞ্জয় বাবুকে চাই। সম্প্রতি একটা বাংলা ছবি জুবিলি করেছে। তার সবচেয়ে হিট গানটা আবার ওনারই গাওয়া। এজন্য বেশ মোটা অঙ্কের টাকা অফার করতেও ওরা রাজী। বম্বে থেকে আরেক জন নামজাদা বাঙালি গায়ক উনিও উত্তর কোলকাতারই ছেলে তাঁকেও এবার আনছে নবরাগ সঙ্ঘ। কেবল আমহার্স্ট স্ট্রীটের একটি ক্লাবকে টেক্কা দিতে হবে এবার। ওরা হেমেনবাবুকে অলরেডি বুক করে রেখেছে। হেমেন মৃত্যুঞ্জয়ের বন্ধুস্থানীয়। দুজনেই দুজনার গুণগ্রাহী।
মৃত্যুঞ্জয় বাবু রাজী হলেন কেবল একটি শর্তে। একঘন্টার একটা স্লটে প্রাণকৃষ্ণও গাইবেন একক শ্যামাসঙ্গীত। তার জন্য আলাদা পয়সা দিতে হবেনা। উনি নিজে হাজার টাকা কমেই গেয়ে দেবেন, বাকীটা ভাই এর সাম্মানিক হিসাবে দিতে হবে।
এরমধ্যে পূজোয় আর একটা রেকর্ড বেরিয়েছে প্রাণকৃষ্ণর। ‘ মায়ের পায়ের জবা ‘ র বিক্রির রিপোর্ট মোটামুটি ভালই। চারটি গান দুটি পিঠ মিলিয়ে। এরমধ্যে
‘ আমার সাধ না মিটিল ‘- টাই বেশী হিট হয়েছে।
আজকাল আসরগুলোতে এই গানটা গাইতেই হচ্ছে। নবরাগ সঙ্ঘেও এই গানটারই দুবার এনকোর কল এল। শেষে
সবমিলিয়ে দুহাজার টাকা প্রাপ্তিযোগ। রুম্পার হাতে এসে টাকার খামটা তুলে দিয়ে একটু হাসিমুখে তাকাল ও। রুম্পার প্রতি অবহেলা করতে মন চায়না মোটেও, তবুও কি করে যেন সব গন্ডগোল হয়ে যায়!
দাদা বৌদিই পাত্রী পছন্দ করে এনে বিয়েটা দিয়েছিল। ধনিয়াখালীর কাছে শ্বশুরবাড়ি ওর। যদিও বিয়ের পর আর নিজে যায়নি দ্বিতীয় বার। তিন বছরে দুটি পুত্রের জনক হয়েছে প্রাণকৃষ্ণ। তারা আবার পিঠোপিঠিই জন্মেছে। দাদা বৌদির ওরা নয়নের মণি। ষোল বছর আগে দাদার বিয়ে হলেও এবাড়িতে সন্তান শুধু প্রাণকৃষ্ণেরই। রুম্পা একটু রুগ্ন স্বাস্থের।বউদি তাই রুম্পার ওপর সংসারের অহেতুক ভার চাপায় নি কখনো সহমর্মী হয়েই।
সন্ধ্যের পর প্রাণকৃষ্ণ আজ গায়ে ঘুষঘুষে জ্বর নিয়েই বাড়ি থেকে বের হলো। নিমতলা শ্মশানের গায়ে ভূতেশ্বরের মন্দিরের আশপাশটা গাঁজার ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন । পূজো শেষ, বেশ শিরশিরে একটা হাওয়া এদিকটায়। ও শ্মশানের ভিতরে গিয়ে বসলো। আজকাল যে কোন শ্মশানই ওকে খুব টানে। নিমতলার এদিকটায় মড়ার খাটগুলো একদিকে স্তুপ করা, ফুল, মালা, তোষকগুলোও ডাঁই করা। আজকে অবাক কান্ড এখন কোনও চিতা জ্বলছে না। কিছু পোড়া কাঠ ইতঃস্তত ভাবে তাকিয়ে আছে কালাকালের উদ্ধারিণী গঙ্গার দিকে। কয়েকটা তার মধ্যে ভাসছেও। এসবই ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকে এক অতীন্দ্রিয় জগতে। কানে কানে অজস্র মৃত্যু যেন ফিসফিস করে কথা বলে যায়। তার মধ্যেই কখনো কখনো একটা জ্যোর্তিবলয়ের মধ্যে ত্রিনয়ন জ্বলজ্বল করে। ঘোর তামসী রূপ, কিন্তু না তাকিয়ে পারা যায় না কোনওমতেই। চারপাশের জগতটা তুচ্ছ হয়ে যায় তখন। এরই মধ্যে হঠাৎ হরিধ্বনি দিতে দিতে একটা মড়া এলো। একজন ডোম মদ খেয়ে টলছে। সেই টলতে টলতে চিতার সরঞ্জাম জোগাড় করতে গেল।
মৃতদেহটি একজন কমবয়েসী সধবা মহিলার। বড়জোড় পঁচিশ ছাব্বিশ হবে। চওড়া পাড়ের লাল শাড়ি আর একমাথা লাল টকটকে সিঁদূরে কি বীভৎস লাগছে। প্রাণকৃষ্ণ উঠে পড়তে চাইল। কিন্তু সেই মৃতা নারীর মুখটা কিছুতেই চোখের সামনে থেকে যাচ্ছে না। কোথায় যেন দেখেছে সে এই একই মুখ? দূর থেকে আসা একরাশ নীলাভ আলোর তরঙ্গে নেচে নেচে ভেসে আসছে সেই ত্রিনয়ন সেটা আবার খুবই দীপ্তিময়। অলৌকিক ভাবেই ওই মৃতা বউটির মুখটায় এসে চোখগুলো যেন মিলিয়ে গেল ! মাথার ভিতরটা ঘুরছে কিরকম ওর।
সে রাত্রে আর বাড়ি ফেরা হলোনা ওর।
পাড়ায় কালীপূজোর প্যান্ডেলের বাঁশ পড়েছে সবে। এখনো দিন চারেক বাকী।
পাড়ার ছেলেপুলেরাই করে পূজোটা বাড়ি বাড়ি চাঁদা তুলে। ভাইফোঁটার পরদিন একটা ছোট করে জলসা হয়। মৃত্যুঞ্জয় বাবু আর প্রাণকৃষ্ণ এদের দুজনের গান তো থাকেই,কখনো সখনো মৃত্যুঞ্জয় বাবুর খাতিরে দু একজন প্রতিষ্ঠিত শিল্পীও এসে যোগ দেন। কেউই কোন টাকাপয়সা নেন না। মুখোপাধ্যায় বাড়িতে একটা বড় রকমের ভোজ হয় সেদিন। প্রায় একশো জনের পাত পড়ে। সবাই নিজের হাতে খাবার পরিবেশন করে। সে এক হৈ হৈ ব্যাপার।
প্রাণকৃষ্ণ এই ক’দিন আর কোথাও বের হয়নি। সকালে একটু রেওয়াজ করা ছাড়া আর তার গলার আওয়াজও কেউ পায়নি। মোহনবাগানের খেলা ছিল এরমধ্যে। বন্ধু পুলক ডাকতে এসে ফিরে গেছে। কেমন একটা একাকী ঘোরের মধ্যে কেটে যাচ্ছে দিনগুলো। দাদা বৌদি মিলে নিজেদের গাড়ীতে করেই রুম্পা আর বাচ্চাদের ওর বাপের বাড়ি রেখে এসেছে। কালীপুজো-ভাইফোঁটা কাটিয়ে ওরা ফিরবে বোধহয়। রুম্পা আবার নতুন করে সন্তানসম্ভবা। তাই এই বাড়তি সতর্কতা।ওরা যখন যাচ্ছে বারান্দা থেকে ওদের যাওয়াটা দেখতে দেখতে একটু মনখারাপ হয়ে গেল। ঘরে ঢুকে গানের খাতাটা বের করে রামপ্রসাদী গানগুলো দেখছিল প্রাণকৃষ্ণ।
” দিয়েছ এক মায়া চিন্তে,সদাই মরি তারই চিন্তে, না পারিলাম তোমায় চিনতে, চিন্তা কূপে ডুবে মরি ! ”
পুরো লাইনটাতে ‘মরি’ শব্দটায় বারবার এসে চোখ আটকে যাচ্ছে। ঘরে বৌদি খাবার ঢাকা দিয়ে গেছে। আজ তো চোদ্দশাক খেতে হয় না? কালীপূজোও এসে গেল তবে। একসময় ভাল তুবড়ি বানাত ওরা কজন বন্ধু মিলে নিজেরাই । সেইদিনগুলো আর কখনো ফিরবে না।
প্রাণকৃষ্ণ একটা প্যাডের পাতা টেনে কিছু লেখার চেষ্টা করতে বসলো। কিছু কথা, যেটা বলে হয়ে ওঠা হয়নি কখনো। কিন্তু কাকে লিখবে? দাদা? বৌদি? রুম্পা কে?
মাথা কাজ করছে না। কি লিখলে ঠিক হবে?
প্রাণকৃষ্ণর মাথার ভিতর আবার ব্যথা শুরু হয়। ওই নিমতলায় দেখা সধবা মহিলার লাল টকটকে সিঁদূর মাখা মুখটা কেন বারবার চোখের সামনে আসছে? এইবার !এইবার সেই নীলচে সবুজ জলতরঙ্গের মতো আলো আর ত্রিনয়ন ! এবার একটা বিশাল মুখব্যাদান করা করাল হাঁ মুখ, ওকে গিলে খেতে আসছে যেন ! আর সমস্ত দেহে খেলছে বিদ্যূতের আলপনা…
প্রাণকৃষ্ণ যন্ত্রচালিতের মত পরণের কাপড়টা নিজের অজানিতেই কখন খুলে গলায় ফাঁস লাগিয়ে পড়িয়ে দিল। না না , নিজে নয়, অন্য একটা জল্লাদের হাত যেন, কি দৃঢ়, কি পেশীবহুল! কি কালো! একটা হাত ! কার হাত ওটা? শেষবারের মত জ্ঞান হারানোর আগে অনাগত সন্তান যার এখনো পৃথিবীর আলো দেখার সময় আসেনি তার মুখটুক দেখবার বড় সাধ হচ্ছিল আর সাথে সাথে তা না মিটতে পারার দুঃখও।
কালীপূজোর দিন সকালে যখন প্রাণকৃষ্ণর নিষ্প্রাণ দেহটা সি ডি ভ্যানে পুলিশ তুলে নিয়ে যাচ্ছিল তার খানিক আগেই পাড়ার প্যান্ডেলে রেকর্ড প্লেয়ারে প্রাণকৃষ্ণর গাওয়া শ্যামাসঙ্গীত গুলোই একটার পর একটা করে বাজছিল।
এখন যদিও পুরো পাড়াটায় মৃত্যুর নির্মম কাঠিন্য শুধু জেগে আছে।
—::ooXXoo::—