অভিজ্ঞানম্
◆◇◆◇◆◇◆
–:: শ্যামাপ্রসাদ সরকার ::–
সখীচতুঃষ্টয় পরস্পরকে আকর্ষণ করে রোরুদ্যমানা। তিনটি সদ্যন্মোষিত উদ্ভিন্ন যুবতী আর চতুর্থটি বনের হরিণী একটি। এ যুবতীত্রয়ের প্রধানাটি আজ বেতস লতার গহনার সঙ্গে চন্দনের সাজে অনুপমা, তার কন্ঠের যূথীকার মাল্যটি তার অসূয়া বিহীনা ও প্রিয়ভাষিণী দুই প্রিয়সখীর স্বহস্তে গ্রথিত। পতিগৃহের উদ্দেশ্যে তপোবালাটির বিচ্ছেদবিরহের শুভক্ষণটি অবশেষে আগত। যাত্রামুহূর্তের ঠিক পূর্বে প্রিয়তম প্রদত্ত অভিজ্ঞানটি অনামিকায় ধারণ করে হোমাগ্নিকুন্ডটি শেষবার প্রদক্ষিণ করে বধূবেশী তাপসীকন্যা।
***
এই অবধি রচনা করে আপাততঃ সাময়িক বিরতিতে ময়ূরপুচ্ছের লেখনীটি মসীপাত্রে নামিয়ে রেখে কবিমন গগনবিহারী হয়ে আজ কিঞ্চিৎ উন্মনা। উজ্জ্বয়িনীর পূর্বাকাশ নবজলধরে পূর্ণগর্ভা। এই ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবস’ যে কবির বড়ই প্রিয়। নববর্ষার পূর্বমেঘ তাঁকে উতলা করে তোলে চিরকালই। মনে হয় যেন কোন বিরহী প্রাণ তার প্রিয়াকে পত্র প্রেরণ করেছে আসন্ন আসঙ্গলিপ্সা জানিয়ে। আর এই ভাসমান কৃষ্ণবর্ণের নীরদপুঞ্জ যেন ভেসেছে তারই দৌত্যে। আর একটি নূতন কাব্যরচনার প্রেরণা আসায় কবিবর নিজের মনে স্মিত হাস্যে বন্ধুবর শূদ্রকের পরিহাসবাচন স্মরণ করেন। শূদ্রক সম্প্রতি ‘মৃচ্ছকটিকম্ ‘নামে একটি সুপাঠ্য নাটিকা সৃজন করে নবরত্নসভায় অতি প্রশংসিত। সে বলে ‘ কবিবর, আপনি সরস্বতীর বরপুত্র। মুহূর্তের স্ফূরণে আপনি শত শত ‘কুমারসম্ভবম্’ বিরচিত করে কাব্যপিপাসা নিবারণে সক্ষম! তবু অনুরোধ, রাজ অজ্ঞায় বিগলিত হলেও কিঞ্চিৎ কম পরিমাণ কাব্য রচনা করে আপনার কাব্যস্রোতপ্রবাহ রক্ষা করুন এই প্রার্থনা !’
একথা সত্য যে শিপ্রাতীরের পর্ণকুটিরটি নিরন্তর কবিবরের কাব্যরসধারায় প্লাবিত হয় !
মৃগচর্মাসন থেকে উত্থিত হয়ে কবিবর গৃহমধ্যে প্রবেশ করে চপলা বালিকা সুহাসিনী কে স্মরণ করেন। কন্যারূপেই তিনি অষ্টমবর্ষীয়া এই সদাচঞ্চল বালিকাটিকে লালনপালন করেন। এর জন্মবৃত্তান্ত বড় বিচিত্র। প্রাতঃকালে সূর্যপ্রণাম সমাপন শেষে শিপ্রার ঘাটে সদ্যজাত এই শিশুটিকে হঠাৎই প্রাপ্ত হন। বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে দুটি শকুন্ত পক্ষী তাদের পক্ষবিস্তার করে মানবশিশুটিকে রক্ষা করছিল তখন। কবিবর সযত্নে মাতৃ পরিত্যক্ত শিশুটিকে নিজগৃহে স্হান প্রদান করেন। কবির নারীভাগ্য এতকাল বিরূপই ছিল। কন্যাটির আগমনের অল্পকাল পরেই তিনি নবরত্ন সভায় স্হান লাভ করেন আর কুমার সম্ভবের কবিও নন্দিত হন।
***
সমস্ত দিন এই কন্যাটি তাঁর গৃহে যাপন করলেও রাত্রিবাস করে পার্শ্ববর্তী মালিনী র কুটিরে। মালিনী নিঃসন্তান। তার জ্বালা সে সুহাসিনীর চপলতায় ভুলে থাকে। রাজঅন্তঃপুরে যাওয়ার পূর্বে প্রত্যহ কিছু পুষ্প তার জীবনদেবতা কবিবরের গবাক্ষপথে রেখে নিষ্ক্রান্ত হয়।
সুহাসিনী বড়ই চঞ্চলা। কবির তালপত্রের পুস্তিকা আর ময়ূরপুচ্ছের লেখনী গুলি তার বড় পছন্দের। এগুলি তার খেলবার বস্তু। নিত্যই সে এগুলি স্হানান্তরিত করে ও কবি সেগুলি প্রয়োজনের সময় প্রাপ্ত হন না। তখন মালিনীর শরণাপন্ন হতে হয়। সম্প্রতি গোপপল্লীর এক সমবয়সী সাথী বালকের সঙ্গেই তাকে প্রায়সই দেখা যায়। বালকটি বংশীবাদনে বেশ সুপটু। কবিবর দেখেন শিপ্রার অপর পারের গোচারণরত গোপবালকটির বংশীবাদনে সেই চপলা বালিকা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গোবৎসদের মাঝে চুপ করে গালে হাত দিয়ে আকাশপথে তন্ময়দৃষ্টি মেলে আছে।
কবিবর বড় আনন্দিত হন। তিনি সত্য, শিব, সুন্দরের উপাসক। মহাকালেশ্বরের কৃপায় এ জীবনের যা কিছু সুন্দর তা তাঁর কাছে ধরা দিয়েছে কাব্যের উৎসারে, এজন্য তিনি ধন্য। কুটিরে দ্রুত পদচালনা করে ফিরে আসেন। নবাগত কাব্যের সূত্রটি এক্ষণে লাভ করলেন নূতন রূপে।
তাঁর নায়িকাকে তিনি রচনা করবেন এবার সুহাসিনীরই আদলে।
কল্পনায় তিনি দেখতে পান কাহিনীর রূপচ্ছায়াটি। নায়িকার জন্ম, পালক পিতার বৃত্তান্ত, তপোভূমির জীবন, পূর্বরাগ, বিবাহ, বিরহ ও প্রিয়মিলনকে কল্পলোকে স্থান দেন কবিবর। এই হোক তাঁর প্রেম ও অমৃতময়তার এক অনন্য অভিজ্ঞান।
○●○●○●○●○●○●○