ঈশ্বর কণা
– শ্যামাপ্রসাদ সরকার –
****
কলকাতায় অঘ্রাণের শেষ দিক। গঙ্গার হাওয়ায় ভেসে আসছে শিরশিরে উত্তুরে হাওয়া। ১৮৫৬ সনের ৭ ডিসেম্বর দিনটি। ১২৬৩ বঙ্গাব্দের ২৩ অঘ্রাণ | আজ কলকাতায় ১২ নম্বর সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়িতে বিপুল ভিড় | বাড়িটির গৃহস্বামী রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় |
এত ভিড় কেন আজ সেই বাড়িতে ?
আজ সন্ধ্যায় সেখানেই যে হতে চলেছে এক সমাজবিপ্লব। এদেশের প্রথম বিধবাবিবাহ |
বিধবাবিয়ের প্রথম পাত্রী বর্ধমান জেলার পলাশডাঙানিবাসী ব্রহ্মানন্দ মুখোপাধ্যায়ের পনের বছরের বিধবা মেয়ে কালীমতি | মেয়েটির আট বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল পঞ্চাশ বছরের এক কুলীন ব্রাহ্মণের সাথে।বিবাহের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সন্ন্যাসরোগে তার মৃত্যুর সাথে সাথে ব্রাহ্মণটি কালীমতি সহ আরো দশটি স্ত্রীকে প্রদান করে গেলেন অনিবার্য বৈধব্য । সাতটি বিধবার বন্দোবস্ত হল কাশীতে। একটি অন্য এক আত্মীয়ের সাথে ভ্রষ্টা হয়ে স্থান পেল রামবাগানের কুপল্লীতে। আর অন্যদুটির একটি অজ্ঞাত কারণে আত্মঘাতিনী হলেন আর কালীমতি রয়ে গেল পিত্রালয়েই। এইরকম এক বিধবাকে বিয়ে করার সাহস দেখাবে কে ?
পাত্র যোগাড় করলেন ঈশ্বরের বন্ধুবর মদনমোহন তর্কালঙ্কার। খাটুরা গ্রামের বিখ্যাত কথক রামধন তর্কবাগীশের পুত্র‚ সংস্কৃত কলেজের কৃতী ছাত্র‚ অধ্যাপক শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন | এই বিয়ের জন্যে প্রায় ৮০০ নিমন্ত্রণপত্র ছাপা হয়েছে | নিমন্ত্রণপত্রটি রচনা করলেন এই তেজোদ্দীপ্ত ব্রাহ্মণ যুবক পন্ডিতটি স্বয়ং —
“শ্রী লক্ষ্মীমণি দেব্যাঃ সবিনয়ং নিবেদনং | ২৩ অগ্রহায়ণ রবিবার আমার বিধবা কন্যার শুভবিবাহ হইবেক | মহাশয়েরা অনুগ্রহ পূর্ব্বক কলিকাতার অন্তঃপাতী সিমুলিয়ার সুকেয়া ষ্ট্রিটের ১২ সংখ্যক ভবনে শুভাগমন করিয়া শুভকর্ম সম্পন্ন করিবেন‚ পত্রদ্বারা নিমন্ত্রণ করিলাম ইতি- | |”
আবারও একটি বিপ্লব। এবারে মায়ের নামে মেয়ের বিয়ের নিমন্ত্রণপত্র !
সময়ের জাঁতাকলটিকে নিজের মেধা আর আত্মশক্তিতে তিনি ঘোরাচ্ছেন এখন। আগামীকালের ভারতবর্ষ তাঁকে বিস্মৃত হলেও কখনো অস্বীকার করতে পারবেনা।
****
বাবু কালীপ্রসন্ন সিংহ জমিদার তনয় হয়েও অন্য ধাঁচের। বিদ্যানুরাগী সদ্য কৈশোর অতিক্রান্ত জমিদারপুত্রটি ইতিমধ্যেই ঈশ্বরচন্দ্রকে গুরু মানে। এই বিয়ের জন্য আগেভাগেই দু’হাজার টাকা সে গুরুপ্রণামী বাবদ দিয়েছে। আজ অবশ্য সে আসতে পারেনি ঠিকই কিন্তু বিবাহসভায় উপস্থিত আছেন বাবু দিগম্বর মিত্র‚ বাবু প্যারীচাঁদ মিত্র, রাজা জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ বিশিষ্টজনেরা। এঁরাও এনেছেন যৌতুক ও বিবিধ দানসামগ্রী। সভা তদারক করছেন স্বয়ং বিদ্যাসাগর। শহর কলকাতার রাজপথ আজ মানুষে আচ্ছন্ন | সাহেব সার্জেনরা জনতা নিয়ন্ত্রণ করছে | রাত প্রায় ১১ টায় বর এল | শুভলগ্নে কন্যাদান করলেন পাত্রীর মা লক্ষ্মীমণি।
******
বিয়ের সম্প্রদান, আচার অনুষ্ঠানের পর একটু লেবুর শরবৎ খেলেন ঈশ্বরচন্দ্র। আজ তাঁর মনটি বড় প্রসন্ন। সমাজের জগদ্দল পাথরটিকে একটু হলেও যেন সরাতে পেরেছেন। মনটা উন্মনা হয়ে যাচ্ছে থেকে থেকেই। চোখের সামনে ভেসে উঠছে একটি দৃশ্য!
” নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ | পঞ্চস্বাপৎসু নারীণাং পতিরণ্য বিধীয়তে |”
— এই যে টুলো পন্ডিত‚ তুমি কি আদৌ অর্থটি জানো এই শ্লোকের ? গড়গড়ার নলটা মুখ থেকে সরিয়ে ঈষৎ ভ্রূকুটিকুঞ্চিত করে প্রশ্নটা করলেন কলকাতার সর্বমান্য জমিদার রাধাকান্তদেব বাহাদুর মহাশয়। একদা সংস্কৃতে শব্দকল্পদ্রুম প্রণয়ণের সাথে সাথে বিবিধ সামাজিক কর্মকান্ডের মধ্যে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা এমনকি সনাতনপন্থীদের নেতৃত্বও প্রদান করেছেন অবলীলায়। একরোখা পুরুষ তিনি নিজেও, নইলে রাধানগর নিবাসী আর এক যুগন্ধর পুরুষ যিনি কিনা একদা ছিলেন বন্ধুস্থানীয় সেই রাজা রামমোহনের সাথেও সমানে টক্কর দিয়েছেন সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদের বিরোধিতা করে। যদিও সে খেলায় তিনি পরাজিত। বেন্টিঙ্ক সাহেব রামমোহনের সুরে সুর মিলিয়ে ওই লোকাচারটিকে বেআইনী ঘোষণা করে দিয়েছেন। তবে তাঁর প্রতাপ প্রতিপত্তি এখনো কমেনি। নবদ্বীপ, ভাটপাড়া সহ কলকাতা শহরের অসংখ্য ব্রাহ্মণেরা তাঁরই মাসোহারায় আজও অন্নপান করে থাকেন। বৈশাখের এক বিকেলে তিনি স্বয়ং শোভাবাজারের নাটমন্দিরে বসিয়েছেন এক বিতর্কসভা। এবারের বিষয়টা আরও সাংঘাতিক! বিধবা বিবাহ!
***
পন্ডিতটি যুবকবয়সী। অত্যন্ত মেধাবী ও নিরহঙ্কারী। তবে আদর্শের খাতিরে মেরুদন্ড টানটান করে রুখে দাঁড়াতে পারেন। পিতৃদত্ত নাম ঈশ্বরচন্দ্র। সবাই তাঁকে ‘বিদ্যাসাগর’ বলে ডাকে। সংস্কৃত কলেজে অতি অল্পবয়সে তিনি এই খেতাবটি অর্জন করেছেন। সাহেবদের ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা পড়ান আর সংস্কৃত কলেজে সামলান অধ্যক্ষের পদ। এর মধ্যেই তিনি নিজেকে নিযুক্ত করেছেন এক শাস্ত্রসাগর মন্থনে। বিধবা বিবাহের শাস্ত্রবাক্য সমর্থন সন্ধানে এত মাসের পরিশ্রমের পর তিনি অবশেষে পেয়েছেন পরাশর সংহিতায় এই সটীক শ্লোকটি।
***
“আপনারা নিজেরাই পরাশরের দোহাই দিয়ে হিন্দুবিধবাদের ওপর যুগ যুগ ধরে এই অত্যাচার করছেন কেন ? পরাশর-ই তো বলেছেন …”
বিদ্যাসাগর সিংহের মতো গম্ভীর গলায় বললেন — “শুনুন তাহলে পরাশরের ব্যাখ্যাটি। শুধু আমিই জানি না | আপনারা জেনেও জানেন না জানার ভান করে আছেন | ইচ্ছে করে যুগ যুগ ধরে ভুল ব্যাখ্যা করেছেন। রাজা রাজবল্লভ তাঁর বিধবা কন্যার পুনর্বিবাহ প্রদানে নবদ্বীপের নৈয়ায়িকমন্ডলীর কাছে বিধান চেয়েছিলেন। তাঁরাই এই শ্লোকটি উদ্ধার করেন কিন্তু নদীয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের কূটরাজনীতিতে তারা সবাই উৎকোচ গ্রহণ করে এর অপব্যাখ্যাটি প্রচার করেছিলেন। একশো বছরেও সেই ভুল শোধরাতে কেউ এগিয়ে আসলেন না! শুনুন তবে – স্বামী যদি নিরুদ্দেশ হয়‚ মারা যায়‚ প্রব্রজ্যা বা সন্ন্যাস নেয়‚ ক্লীব বা জরাগ্রস্ত‚ পুরুষত্বহীন বা অক্ষম হয়‚ যদি পতিত হয়‚ তাহলে এই পঞ্চপ্রকার আপদে নারীর অন্য পতি গ্রহণ বিধেয় | ” এই উক্তি স্বয়ং পরাশরের !
পণ্ডিতসভায় যেন বাজ পড়ল | পরাশরের এই ব্যাখ্যা করলে তো হিন্দু সমাজ ভেঙে পড়বে | পণ্ডিতেরা অতিকষ্টে একটি দুর্বল প্রতিপক্ষ যুক্তি খাড়া করলেন | তাঁরা বললেন‚ পরাশর এই শ্লোকে স্বামীর কথা বলেননি‚ বলেছেন বাগদত্ত পাত্রের কথা | পাঁচটি আপদে কন্যাকে ওই পাত্রের হাতে না দিয়ে অন্য পাত্রের সঙ্গে তার বিয়ে দেওয়া যেতেই পারে | কিন্তু বিধবার বিয়ে ? ‘ন অস্তি!’ রাধাকান্তদেব বাহাদুর নিজে সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিত! তিনিও সবিস্ময়ে চেয়ে তাকেন যুবক ঈশ্বরচন্দ্রের তেজোময় মুখের দিকে। মুখে তাঁর ম্লান হাসি, কিন্তু সরাসরি কিছু বলতে যেন কোথায় ব্যথা পাচ্ছেন। নাঃ পরিবর্তনের কাল এলে পুরনো বাতিল প্রথাগুলো খড়কুটোর মত এভাবে ভেসে তো যাবেই। সেবারে রাজা এসে শুরু করেছিলেন, এবারে শেষ করবে বিদ্যাসাগর।
নিশ্চুপ সভায় সিংহবিক্রমে গর্জে উঠলেন ঈশ্বরচন্দ্র,
— তবে শুনে রাখুন আপনারা‚ পরাশরে বিধবাবিবাহের কথা থাকুক বা না থাকুক‚ বিধবাবিবাহ হবেই | কারণ আমি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বলছি!
তালতলার চটির ফটফট শব্দে শোভাবাজারের নাটমন্দিরে আসন্ন ঝড়ের ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বেরিয়ে আসলেন।
****
সিঁদূরদান আর বাকী মঙ্গলাচরণের পর লক্ষ্মীমণি মেয়ে জামাইকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর সামনে। মানুষটির দুচোখ আজ জলে টলটল করছে। বজ্রাদপী লৌহপুরুষটির হৃদয়ে এক বাঙালী কোমল মাতৃহৃদয় লুকিয়ে আছে। নবদম্পতি গৃহদেবতা শ্রীধরকে প্রণাম করার আগে এসেছে জোড়ায় তাঁর চরণদুখানি ছুঁতে।
তাদের জীবনে তারা জীবন্ত ‘ঈশ্বর’ দর্শনে আজ ধন্য।
**সমাপ্ত**