তুলসী
◆◇◆◇◆
তুলসী ইংরেজি শব্দ Holy Basil, যার বিজ্ঞানসম্মত নাম Ocimum Sanctum. এটি একটি মহা ঔষধি গাছ। তুলসী-র অর্থ যার তুলনা নেই। তুলসী গাছ লামিয়াসি পরিবারের অন্তর্গত একটি সুগন্ধী উদ্ভিদ। হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে এটি একটি পবিত্র উদ্ভিদ হিসাবে সমাদৃত। ব্রহ্মকৈবর্তপুরাণে তুলসীকে ‘সীতাস্বরূপা’, স্কন্দপুরাণে ‘লক্ষীস্বরূপা’,চর্কসংহিতায় ‘বিষ্ণুপ্রিয়া’, ঋকবেদে ‘কল্যাণী’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তুলসী গাছ হল ভারতবর্ষের শাস্ত্রমতে খুব পবিত্র একটি গাছ এবং এই গাছের বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব আয়ুর্বেদ ও নানা চিকিৎসার ক্ষেত্রে ভীষণভাবেই দেখা যায়। তুলসী হল মূলত পুদিনা গাছেরই একটি ধরণ যার আবার নানারকমের ভাগ আছে। যেমন, রাম তুলসী, কৃষ্ণ তুলসী ও বান তুলসী। তবে এই প্রত্যেকটি ধরণের তুলসী গাছই বিভিন্ন রকমের অসুস্থতাকে চিকিৎসা করতে সমানভাবে কার্যকরী। প্রায় ৫০০০ বছর ধরে এই তুলসী গাছ ভারতের উত্তর-মধ্য-পূর্ব অঞ্চলে চাষ করা হয়ে আসছে এবং এখন ভারতবর্ষের সমস্ত এলাকায় এটি চাষ করা হয়। আমরা আপনাকে তুলসী পাতা সম্পর্কে নানা রকমের তথ্য বিশেষ করে তুলসী পাতার উপকারিতা ও তুলসী পাতার গুণাগুণ সম্পর্কে আলোচনা করবো। তুলসী পাতায় রয়েছে এন্টি ইনফ্লেমেটরি ও এন্টি অক্সিডেন্ট উপাদান যা ক্যান্সার, ডায়বেটিস বা হৃদরোগের মত নানা মারণাত্মক রোগের বিরুধ্যে শক্তিশালী রূপে লড়াই করতে পারে। তুলসী পাতায় এতখানি ঔষধিক গুণ রয়েছে যে স্বয়ং এই পাতাকেই একটি ওষুধ বলে গণ্য করা হয়। তুলসী একটি ঘন শাখা প্রশাখা বিশিষ্ট ২/৩ ফুট উচু একটি চিরহরিৎ গুল্ম। এর মূল কাণ্ড কাষ্ঠল, পাতা ২-৩ ইঞ্চি লম্বা হয়। পাতার কিনারা খাঁজকাটা, শাখাপ্রশাখার অগ্রভাগ হতে ৫ টি পুষ্পদণ্ড বের হয় ও প্রতিটি পুষ্পদণ্ডের চারদিকে ছাতার আকৃতির মত ১০-২০ টি স্তরে ফুল থাকে। প্রতিটি স্তরে ৬টি করে ছোট ফুল ফোটে। এর পাতা, ফুল ও ফলের একটি ঝাঁঝাল গন্ধ আছে।
কোথায় পাওয়া যায় :-
বাংলাদেশ ও ভারতের প্রায় সর্বত্র দেখা যায়। এটি হিন্দুবাড়িতে বেশি দেখা যায় এছাড়া পূজাতেও ব্যবহার হয়। ভারতে বাণিজ্যক ভাবে চাষ হয়। জুলাই আগস্ট বা নভেম্বর ডিসেম্বর এতে মঞ্জরী দেখা দেয়। সমতলভূমি থেকে শুরু করে হিমালয়ের পাদদেশে প্রায় ৬০০০ ফুট উচ্চতা পর্যন্ত এদের জন্মাতে দেখা যায়।
আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে এর ব্যবহার :-
তুলসী গাছের নানা ঔষধি ব্যবহার রয়েছে। সর্দি, কাশি, ঠাণ্ডা লাগা ইত্যাদি নানা সমস্যায় তুলসী ব্যবহার করা হয়। এ গাছের রস কৃমি ও বায়ুনাশক। আয়ুর্বেদিক ঔষধ হিসাবে এই গাছের ব্যবহার্য অংশ হলো এর রস, পাতা এবং বীজ। যে চার প্রকার তুলসী গাছ দেখা যায় সেগুলি হলো – বাবুই তুলসী, রামতুলসী, কৃষ্ণ-তুলসী, ও শ্বেত তুলসী।
আসুন আমরা তুলসী পাতার উপকারিতা ব্যবহার এবং তার ক্ষতিকর দিক সম্পকে জেনে নিই।
তুলসী পাতার উপকারিতা :-
মানসিক চাপ : –
বেশিরভাগ দেশে তুলসীকে মানসিক চাপ মুক্ত করার একটি অসাধারণ ঔষধি হিসেবে ধরা হয়। এছাড়া এই পাতায় রয়েছে এন্টি ইনফ্লেমেটরি ও রোগ প্রতিরোধ করার উপাদান যা সারাদিনের ক্লান্তি ও চাপ নিমেষের মধ্যে দূর করতে পারে। তুলসী শরীরের কর্টিসোল মাত্রা কমিয়ে আনতে পারে ও অতিরিক্ত উত্তেজনা ও চাপ থেকে মুক্তি দেয়। স্বাভাবিকভাবেই মানসিক চাপ কমলে আপনি যেকোনো বিষয়ে নিখুঁতভাবে লক্ষ্য রেখে কাজ করতে পারবেন। শরীরে নানারকমের রাসায়নিক চাপ থেকেও তুলসী পাতা উপকারিতা প্রদান করে। তুলসী পাতার দ্বারা শরীরের অন্তর্নিহিত শক্তি জেগে ওঠে ও ধীরে ধীরে চাপ কমে আসে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা : –
তুলসী পাতায় রয়েছে অসাধারণ রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা যেমন এস্থেমা, ফুসফুসের সমস্যা, ব্রঙ্কাইটিস, ইত্যাদি। ঠাণ্ডা লাগলে বা সর্দি কাশি হলে বুকে কফ বসে গেলে তুলসী পাতার দ্বারা তা তরল করে খুব সহজে শরীর থেকে দূর করা যায় এমনকি, জ্বরের সময়ও তুলসী পাতা খুব উপকারী। বর্ষাকালে এই তুলসী পাতা ও এলাচ ভালো করে জলে ফুটিয়ে সেই জল পান করলে খুব সহজেই নানারকমের রোগের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। বিভিন্ন সার্জারির পর বা কোনো ক্ষতস্থানে তুলসী পাতা বেটে লাগালে তা বেশ তাড়াতড়ি শুকিয়ে ওঠে।
ওজন কমানো : –
তুলসী পাতার দ্বারা রক্তে সুগারের মাত্রা ও কোলেস্টরল দুটোই রোধ করা যায় যার ফলে খুব সহজেই আপনি ওজন বৃদ্ধির হাত থেকে মুক্তি পেতে পারেন। তার ওপর কর্টিসোল মাত্রা কমার ফলে যখন আপনার মানসিক চাপ দূর হয়, তখন ওজন কমানো আরো সহজ হয়ে যায়। সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে তুলসী দিয়ে তৈরী ২৫০ মিলিগ্রামের একটি ক্যাপসুল প্রতিদিন খাওয়ার ফলে ওবেসিটি ও লিপিড প্রোফাইল মারাত্মক ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
দাঁতের স্বাস্থ্য : –
তুলসী দিয়ে দাঁতের জন্যে নানারকমের টুথপেস্ট ও মাউথ ওয়াশ তৈরী করা যায় কারণ এতে রয়েছে এন্টি ব্যাক্টিরিয়াল উপাদান এছাড়াও, এতে রয়েছে এন্টি মাইক্রোবিয়াল উপাদান যা দাঁতের যেকোনো সমস্যা, মাড়ির সমস্যা ও মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে সাহায্য করে।
গলা ব্যথা : –
গলা ব্যথা কমাতে তুলসীর জুড়ি মেলা ভার। শ্বাসকষ্টের সমস্যা কমাতেও তুলসী পাতা বেশ উপকারী একটি তুলসী পাতা দিয়ে ফুটিয়ে রোজ গার্গেল করলে গলা ব্যথা নিমেষে সেরে যায়।
ক্যান্সার : –
ক্যান্সার রোগ প্রতিরোধ করতে তুলসী পাতা দারুণ উপকারী। তুলসী পাতায় রয়েছে রেডিওপ্রটেকটিভ উপাদান যা টিউমারের কোষগুলিকে মেরে ফেলে। তুলসী পাতায় থাকা ফাইটোকেমিক্যাল যেমন রোসমারিনিক এসিড, মাইরেটিনাল, লিউটিউলিন এবং এপিজেনিন ক্যান্সারের বিরুদ্ধে কাজ করতে অসামান্যভাবে কার্যকরী । অগ্নাশয়ে যে টিউমার কোষ দেখা দেয় তা দূর করতেও তুলসী পাতা দারুণ উপকারী।ব্রেস্ট ক্যান্সার রোধ করতেও তুলসী পাতা দারুণ উপকারী।
সর্দি কাশি কমাতে : –
ঠাণ্ডা লেগে সর্দি ও কাশি হলে তুলসী পাতা একটি ওষুধের কাজ করে। বুকে কফ বসে গেলে সকালবেলায় রোজ এক পাত্র জলে তুলসী পাতা, আদা ও চা পাতা ভালো করে ফুটিয়ে তাতে মধু ও লেবু মিশিয়ে পান করুন। খুব শীঘ্রই আরাম পাবেন।
রক্ত নালী :-
তুলসী এন্টি ইনফ্লেমেটরি উপাদান থাকার ফলে মাংস পেশিতে রক্ত নালী খুব সচল ও সুরক্ষিত ভাবে রক্ত বয়ে নিয়ে যেতে পারে। এর ফলে শরীরের মাংস পেশিতে ব্যাথা হয় না। এমনকি রক্তে যাতে কোনো রকম জমাট না বাধে তার জন্যেও তুলসী দারুন কাজ করে।
চুলের জন্য তুলসীর উপকারিতা :-
চুল পড়া বন্ধ করে :-
কয়েক ফোটা নারকেল তেলে খানিকটা তুলসী পাতা বাটা মিশিয়ে মাথার স্ক্যাল্পে লাগান। ৩০ মিনিট রেখে চুল শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। এর ফলে চুলের গোড়া মজবুত হবে, স্ক্যাল্পে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পাবে ও চুল পড়ার সমস্যা ধীরে ধীরে চলে যাবে।
খুশকি দূর করে :-
আপনার প্রতিদিনের চুলের তেলের সাথে একটু তুলসী পাতার রস মিশিয়ে সেটি ভালো করে মাথার স্ক্যাল্পে লাগান। এর ফলে স্ক্যাল্পের শুষ্কতা দূর হয় ও খুশকি হওয়া রোধ করা যায়। এমনকি, মাথায় চুলকুনি হলেও তা কমে যায়।
চুলের খুশকি দূর করে, চুলকে নতুন করে উজ্জ্বলতা প্রদান করে ও রুক্ষভাব দূর করতে সাহায্য করে তুলসী পাতা।
পাকা চুলের সমস্যা দূর করে :-
কয়েকটি তুলসী পাতা এক পাত্র জলে ভিজিয়ে সারারাত রেখে দিন। তারপর সেটি বেটে তার মধ্যে আমলকির গুঁড়ো মিশিয়ে সেটি চুলে ভালো করে গোড়া থেকে লাগিয়ে দিন। সকালে উঠে ভালো করে শ্যাম্পু দিয়ে চুল ধুয়ে ফেলুন।
তুলসীর ক্ষতিকর দিক :-
তুলসী পাতা যতই উপকারী হোক না কেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটি এড়িয়ে চলাই ভালো। দেখে নিন ঠিক কোন কোন ক্ষেত্রে তুলসী পাতা খাওয়া উচিত নয়
গর্ভাবস্থা বা স্তন্যপান করার সময় :-
গর্ভাবস্থার সময় বা মা হওয়ার পর স্তন্যপান করানোর সময় সামান্য তুলসী পাতা খেলে কোনো ক্ষতি হয় না, কিন্তু অতিরিক্ত তুলসী পাতা খেলে নানা রকমের জটিলতা দেখা দিতে পারে। তাই এই সময় তুলসী পাতা না খাওয়াই ভালো। এছাড়া অতিরিক্ত তুলসী পাতা মহিলাদের বন্ধ্যাত্বের কারণ হতে পারে তাই নির্দিষ্ট পরিমাণে এটি ব্যবহার করা ভালো।
রক্তপাতের সমস্যা :-
অতিরিক্ত তুলসী পাতা খেলে শরীরে রক্তের প্রবাহ অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ার ফলে শরীরের স্বাভাবিক রক্ত জমাট হওয়ার প্রবণতা নষ্ট হয়ে যায়। এর ফলে অতিরিক্ত রক্তপাতের সমস্যা দেখা দিতে পারে বিশেষ করে কোনোরকম সার্জারি বা কাটা ছেঁড়া হলে ওই সময় তুলসী পাতা এড়িয়ে চলুন। এছাড়া সার্জারির দু সপ্তাহ আগে থেকেও তুলসী পাতা খাওয়া বন্ধ করা উচিত।
নিম্ন রক্তচাপ :-
তুলসী পাতায় অতিরিক্ত পটাসিয়াম থাকার ফলে রক্তচাপ কমে যেতে পারে তাই আপনার যদি নিম্ন রক্তচাপের সমস্যা থেকে থাকে, তাহলে তুলসী পাতা না খাওয়াই ভালো।
যাই হোক না কেন, তুলসী পাতার উপকারিতা সম্পর্কে কোনোরকম সন্দেহের অবকাশ থাকেনা। যখন এই তুলসী পাতায় এতখানি উপকারিতা রয়েছে, তাহলে দেরী কিসের? আজ থেকেই প্রতিদিনের জীবনে এই তুলসী পাতা ব্যবহার করা শুরু করে দিন।
○●○●○●xx●○●○●○
Thank you 🙏🙏🙏