সিঁদূরে মেঘ
– শ্যামাপ্রসাদ সরকার –
************
আজ থেকে প্রায় হাজার বর্ষপূর্বের বঙ্গদেশে একদম যে অরাজকতা ছিল না তা নয়, তবে মূলতঃ হিন্দু প্রধান বঙ্গবাসীদের ধর্মভ্রষ্টের সাথে লুন্ঠনেরও ভয় বাকী দেশের তুলনায় কমই ছিল।
কৃষিমুখী গ্রাম্য বঙ্গবাসী চাষ করত, সপ্তডিঙায় ব্যবসা বাণিজ্য করত আর কুস্তি-পাশা প্রভৃতিতে ব্যস্ত থাকত বলে যুদ্ধের খুব বেশী প্রয়োজন হতনা। দেশে সমৃদ্ধি ও সুশাসন কিঞ্চিৎমাত্র হলেও অবশিষ্ট ছিল। তন্মধ্যেই কেউ কেউ গৌড়রাজপ্রাঙ্গন উজ্জ্বল করে সংস্কৃতেই কাব্য রচনা করতেন আর পন্ডিতগণ দিবারাত্র ন্যায়, স্মৃতি, মীমাংসার কূট বাগযুদ্ধে সুবিশাল অর্কফলা গুলি সজিনার ডাঁটার মতো দোলাতেন।
একটি ঘনায়মান সিঁদূরে মেঘচ্ছায়া উত্তরের আকাশ ছেয়ে আছে। কোথাও নিশ্চয়ই লেলিহান অগ্নিশিখা বোধকরি খান্ডবদহনে প্রবৃত্ত হচ্ছে। অমঙ্গলের আশঙ্কায় রূপশালী স্বেদাক্ত হয়। কিছুক্ষণ পরেই সে বুঝতে পারে সে আসলে স্বপ্ন দেখছিল। দৃঢ়মুষ্ঠিতে সে তার তরুণ স্বামীটিকে আকর্ষণ করে পুনরায় নিদ্রামগ্ন হয়ে পড়ে।
রন্তিদেবের একটি চতুঃষ্পাঠী আছে। চারজন ছাত্র তার অন্নেই প্রতিপালিত হয় ও বিদ্যাচর্চা করে। এই টোল মূলতঃ রন্তিদেবের পিতারই। তর্কবাচস্পতিমহাশয় গত বছর অকালে প্রয়াত হলে রন্তিদেব আচার্য নিযুক্ত হয়েছে। মাত্র কুড়ি বছরেরই পাণিনীর একটি সহজ টিকাভাষ্য রচনা করে আর একটি সংস্কৃত উপক্রমণিকা রচনায় বর্তমানে রত। রূপশালী তার প্রিয়তম পত্নী। এক্ষণে কপোতকপোতীর প্রভাতকালীন গূঢ় প্রেমের বর্ণনার পরিবর্তে একটু গঙ্গার ধার থেকে বেড়িয়ে আসাই শ্রেয়।
গঙ্গার পশ্চিমপ্রান্তে একটি প্রাচীন বটবৃক্ষ আছে। তার মূলকান্ডটি আজ আর দেখা যায়না। সেইখানেই রাজপুত বীর হনুমন্ত সিংহের মল্লচর্চা কেন্দ্র। সেখানে বিশালদেহী যুবাপুরুষের দল মুদ্গর ও মল্লচর্চায় আপাত নিবিষ্ট। মল্লভূমির প্রায় পার্শ্বেই দোলমঞ্চ। শ্যামরায়ের নিত্য পূজা হত পূর্বে এখানে। বর্তমানে তা জঙ্গলাকীর্ণ। পূর্বদিকে নারী ও পুরুষদের পৃথক স্নানের ঘাট। পুরুষদের ঘাটে দুইজন নৈয়ায়িক সুতীব্র আস্ফালনে ‘পাত্রাধারে তৈল না তৈলাধারেই পাত্র ‘ এনিয়ে বিবাদমান।
মহিলাদের ঘাটে একটি রসাল প্রসঙ্গ বারেবারে পরিহাসে ও উচ্চরোলে পরিবেশিত হচ্ছে। তা হল বঙ্গরাজ কূলীনকূলতিলক লক্ষ্ণণসেন সম্প্রতি একটি পঞ্চদশীর পাণিগ্রহণ করেছেন, আর বর্তমানে তাঁর বয়স সত্তর বৎসর। বিধুমুখী সহাস্যে সংযোজন করে যে মহারাজের নীচের পাটির দন্তরাজি নাকি কবেই বিলীয়মান ! পরস্পরের গাত্রে এরা এরূপ প্রত্যহ ঢলাঢলি করেই কিঞ্চিৎ কলকোলাহল করে থাকে।
রাজঅন্তঃপুরে দ্বিপ্রহরের আয়োজনটিও রাজোচিত। আঠাশ রকমের ব্যঞ্জন অম্ল, মধুর,তিক্ত,কষায় সবেতেই মন্মহারাজ বেশ রসিক ও তিনি পরম ঔদিরকও বটে। এই বিপুল আয়োজনের বেশ খানিকটা তিনি উদরস্হ করেই নেন এই সত্তর বছর বয়সেও।পট্টমহিষী ব্যজনহস্তে একেবারে সামনের সারিতে। সামনের পাত্রে রাখা রোহিত মৎস্যের কষায়িত বিশালকায় মুন্ডটি তাঁর অতি প্রিয়। সঙ্গে ঘৃতপক্ক কোমল অজমাসের সুগন্ধে পরিবেশ আমোদিত। অদূরে সদ্যবিবাহিত রাণী অনন্তময়ী পায়সান্ন ও দুধপুলির বাটি হস্তে কম্পমান। মহারাজ আচমন করে শুক্তো সহযোগে সবেমাত্র প্রথম গ্রাসটি গলাঃধকরণ করেছেন, এ সময়ে হঠাৎ প্রতিহারী দেবকান্তের প্রবেশ। দেবকান্ত প্রতিহারী হলেও মহারাজের অঙ্গরক্ষক। অন্তঃপুরে তার অবাধ যাতায়াত। সে জানায় ষোলজন তুরস্কদেশীয় অশ্বারোহীর একটি দল মহারাজের দর্শনপ্রার্থী। তারা উৎকৃষ্ট আরবীঅশ্বের বিক্রেতা। মহারাজের অশ্বশালাটিতে ইদানিং ভালো অশ্বের অভাব। তাই তাদের অতিথিশালায় বিশ্রাম ও অন্নপানের ব্যবস্হার বিষয়ে মহারাজের অাদেশপ্রার্থী। রোহিতমৎস্যের মুন্ডটি চর্বণ করতে করতে মহারাজ স্বস্তিবাচনের ইঙ্গিত প্রকাশ করেন।
রন্তিদেব তার চতুঃষ্পাঠীর পাট চুকিয়ে আপাতত রূপশালীর পাকশালার অভ্যন্তরে। কলমীশাক ভাজা ও অলাবুর একটি উপাদেয় ব্যঞ্জন সে স্বামীকে নিবেদন করে সযত্নে। তারপর স্বামীর পাত্রেই সে অন্নগ্রহণ করে। শেষকালে তাম্বুলচর্বণের সময়ে পরস্পর পরস্পরে আবিষ্ট হয়। এমন সময়ে হঠাৎ প্রলয়ের মত রাজভৃত্য দিনকর কালান্তকের মত দ্বারে করাঘাত করে। সে বলে তখুনি তাদের স্হান পরিত্যাগের জন্য। দিনকর তার পিতৃবন্ধু এবং অভিবাবক তূল্য।সে জানায় আজ যে অশ্ববিক্রেতাগণ মহারাজের অতিথিশালায় উপবিষ্ট তারা আসলে তুরস্কদেশীয় দস্যু বখতিয়ার খলজির সেনাবাহিনী। ছলনা করে তাদের রাজসন্দর্শনের নামে গৌড়দেশ বিজয় ও লুন্ঠনই উদ্দেশ্য। রন্তিদেবের স্মরণে আসে কিয়ৎকাল পূর্বে এরা নালন্দা, ভদন্তপুরী ও বিক্রমশীলা বৌদ্ধবিহার অবাধে লুন্ঠন করেছে শুধু নয়, হাজার হাজার পুস্তিকা ও শাস্ত্রগ্রন্হে অগ্নিশলাকা নিক্ষেপ করে ধ্বংস করে দিয়েছে সেই অমূল্য জ্ঞানভাণ্ডার। স্বয়ং দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান বর্তমানে তিব্বতে অবস্হান হেতু বৌদ্ধশ্রমণের দল জোটবদ্ধ হয়ে বাধা দিতে পারেনি এই দস্যুবর্গকে। এবার তাহলে এদের পূর্বদেশ বিজয়ের অভিপ্রায় !
উত্তরের আকাশে রূপশালী দেখতে পায় ঘনায়মান ধুম্ররেখা। রাজপুরীতে এরা অগ্নিসংযোগ করেছে। শীঘ্রই পল্লীগুলিতে নারীলুন্ঠন শুরু হতে চলেছে। লক্ষ্মণসেনের সেনাদল অকর্মণ্য ও অলস। তাদের হাতেই বঙ্গভূমিকে পরিত্যাগকরে তিনি স্বয়ং মহিষীদের নিয়ে পশ্চাৎএর দরজা দিয়ে পলায়ন করেছেন। এবড়ই দূবির্পাক আজ বাংলাদেশের আকাশে। কিঞ্চিৎ পাথেয় ও শালগ্রাম শিলা, ছাত্রচতুঃষ্ঠয় ও পত্নীর হাতটি সজোরে ধারণ করে রন্তিদেব গৃহত্যাগী হতে ধাবমান হয়।যাত্রাকালে জ্বলন্ত রাজপুরী হতে উদ্ধারিত একটিমাত্র মূলপুস্তিকা ‘ অদ্ভূতসাগর’ যা মহারাজ বল্লাল সেন বিরচিত ও লক্ষ্মণসেন সংযোজিত তা দিনকর সুঅধ্যায়ী রন্তিদেবের হাতে কম্পিত চিত্তে তুলে দেয়। আসন্ন মহাসংগ্রামের কষ্টচিত্ত দিনগুলিতে উপযুক্ত রক্ষকের হাতে প্রাচীন ইতিহাস নীরবে সংরক্ষিত থাকবে, এই তার বিশ্বাস।
——- XX ——-